১৫ শ্রাবণ, ১৩৭৮ রোববার, ১ আগষ্ট ১৯৭১
আট নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টরের যুদ্ধ পরিস্থিতির রিপরতঃ
এ দিন মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীর ২০০ মাইল এলাকা স্বাধীন করে। মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশের প্রশাশনিক কাঠামো. কর ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, গেরিলা তৎপরতাঃ টাঙ্গাইলে শত্রুসেনাদের ১৯ জন নিহত, ৩১ জন আহত, গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে ব্যাপক সংঘর্ষের ফলে শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
বেতাই সাব-সেক্টরের মানিকনগরে ৭ জন খান সেনা নিহত হয়।
শাহজাবপুর রেল ষ্টেশনে হামলা চালিয়ে শত্রুপক্ষের বেশকিছু সংখ্যক সেনা খতম করা হয়।
ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার গ্যাস লাইন কেটে দেয়া হয়, জার কারণে কারখানার উৎপাদন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। (স্বাঃ যুঃ দঃ)
জুলাই এবং আগষ্ট মাসে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারগন গেরিলা দল দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করতে থাকেন। এভাবে নবীগনগর-দাউদকান্দি রুট ধরে নদীপথে ৪ হাজার গেরিলা দল ফরিদপুর ও মাদারীপুর পৌঁছে যায়। নোয়াখালী জেলার গেরিলারা সোনাইমুড়ি-ফরিদ্গঞ্জ, দক্ষিণ ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও রামগতিসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যায়। উত্তারাঞ্চলের গেরিলা রংপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে যায়। পশ্চিমবঙ্গে বনগাঁও, বাগদা, হাসনাবাদ (শমসেরনগর) এবং টাকিতে গেরিলা সমবেত হয়ে ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী অঞ্চলে অপারেশন করে। এই মাসে ২ নং সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফের-এর সুইসাইডাল স্কোয়ার্ড ঢাকা শহরে পাঠালেন, আর ঐতিহাসিক পলাশী নৌ শিবির থেকে নৌ-কমান্ডোগণ দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে যায়। ইতিহাস সৃষ্টি হতে থাকে গেরিলাযুদ্ধে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে যেসব বাহিনী গড়ে ওঠে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’লঃ টাঙ্গাইল জেলার কাদেরিয়া বাহিনী’ গোপালগঞ্জ হেমায়েত বাহিনী, মানিকগঞ্জের ‘হালিম বাহিনী’, এছাড়া আরো দল হ’লঃ ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় আফসার উদ্দিনের দল, নোয়াখালী জেলা এলাকায় সুবেদার লুৎফর রহমান ও সুবেদার শামসুল হকের দল, রংপুর জেলার রৌশরীতে সুবেদার আফতাবউদ্দিনের-দল, কুমিল্লার ফরিদগঞ্জ এলাকায় হাবিলদার গিয়াস উদ্দিনের দল, যশোরের শ্রীপুরে আকবর হোসেনের দল, ধাকা-নরসিংদী এলাকায় মান্নায় ভূইয়ার দল, ফরিদপুর নগরকান্দায় আজিজ মোল্লার দল উল্লেখ্য এসব বাহিনী গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর প্রতি অনুগত ছিল।
-এ দিন ২ নং সেক্টরের মুজাহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা শাকিল মিয়া ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কসবা থানা শালুদা নদী নামক স্থানে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। তার বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার জন্য শহীদ শাকিল মিয়া ‘ বীর উত্তর” উপাধিতে ভূষিত হন।
-এদিন ময়মনসিংহ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ভালুকা থানার ভয়াবহ খেয়াঘাটে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত হামলা চালায়, মারা যায় ৯ জন পাকসেনা। মেজর আফসারের নির্দেশে তার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজন রাজাকার হত্যা করে।
-লন্ডনে পাকিস্তান মিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি মিঃ মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। KCA লিখেছে যে,…declaring that he (Mohiuddin) wished to “live as an independent citizen in an independent country.” Mr Ahmed made this announcement at a Bangladesh rally in Trafalgar square in which some 10000 East Pakistan’s took part(p.24760) উল্লেখ্য, ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে নিয়োজিত ১৫ বাঙালী কূটনৈতিক অফিসার কর্তৃক পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সংবাদে ‘দি গার্ডিয়ান’ (আগষ্ট৯) পত্রিকায় সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হয়ত ঘটনাটি তুচ্ছ বলে গণ্য করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা (কূটনীতিক) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ।
সাধারনতঃ কূটনীতিকগন সর্বশেষ পদত্যাগ করে যখন তা সংঘটিত হয় তখন ব্যাপারটি সকলের নজরে পড়ে। “There is a powerful witness Diplomats are normally among the last people to resign. When it happens it commands attention. “ উল্লেখ্য পাঁচ মাসে কূটনীতি মিশন খুলে কোন জাতি বা দেশ স্বাধীনতা সংগ্রাম এরূপ তৎপরতা দেখিয়েছে তা জানা নেই। আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম তা পারেনি। (লেখক)
ঢাকা শহরে মুসলিম লীগের এক সভায় মুসলিম লীগ সেক্রেটারী এ.এন.ইউসুফ সর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার জন্যে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী দুস্কৃতিকারীদের দায়ী করেন। তিনিন মুসলিম লীগের প্রতিটি কর্মী ও সদস্যকে নির্দেশ দেন রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে দুস্কৃতকারী দমন করার। এ দিন কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতা আবুল কাশেম দেখা করে টিক্কা কাহ্নের সঙ্গে (দৈঃ পাঃ)
শিক্ষা-সংস্কারকে অভিনন্দন জানায় ইসলামী ছাত্র সংঘের পূর্বাঞ্চলীয় সভাপতি নূরুল ইসলাম ও সম্পাদক আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। ছাত্র সংঘের নেতারা দাবি করে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শিক্ষকদের শিক্ষাঙ্গন থেকে বহিস্কারের । তারা হলে এ সব পাকিস্তান বিরোধী শিক্ষকদের কারণেই ছাত্রদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তার জন্ম নিয়েছে। এরাই ছাত্র সমাজকে উস্কে দিয়েছে পাকিস্তান বিরুদ্ধে। (দৈঃ পাঃ) আজাদ
-নিউইয়র্কে ম্যাডিসিন স্কোয়ার গার্ডেন অনুষ্ঠিত হয় এদিন এক অবিস্মরণীয় সঙ্গীত সন্ধ্যা। এ অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তা ছিলেন দু’জন বিটলস চতুষ্টয়ের অন্যতম জর্জ হ্যারিসন এবং বিশ্ব বিখ্যাত সেতারা বাদল রবিশংকর। এ দিনের দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নামক অনুষ্ঠান থেকে বাংলাদেশে শিশু সাহায্যের তহবিলে (UNICEF) প্রদান করেছিলেন ২,৪৩,৪১৮,৫০ ডলার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগে উদ্বেল হয়েছিল খ্যাতনামা কবি শিল্পী গায়ক বিজ্ঞানী ও অন্যান্য সংস্কৃতি সেবী। নিউইয়র্কের ম্যাডিসিন স্কোয়ার, লন্ডনের এ্যালবাট হল, আর্জেন্টিনা, বার্লিনের আলেকজান্ডার প্লাজা, দিল্লীর সঙ্গীত নাটক একাডেমী ও কলকাতার রবীন্দ্র সনদ সর্বত্র মুখরিত হয়েছিল।
-এদিন ‘দি সানডে টাইমস” এ প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধে সাংবাদিক মারে সেই লিখেছেন, “পূর্ব বাংলা পরিস্থিতি সম্পর্কে মিথ্যাপ্রচারে পাক সামরিক সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ মুসলিম দুনিয়া ও খ্রিষ্টান জগতের মধ্যে বিদ্যমান ঐতিহাসিক বিরোধ ‘বি বি সি ও ‘জায়নিষ্ট দের পাকিস্তান বিরোধী ষড়যন্ত্রের উৎস বলে “পাকিস্তান টাইমস” এর সম্পাদকীয় এক নিবন্ধে দাবী করে। মিঃ মারে সেই বলেন, বাংলাদেশের সমর্থক ও পাকিস্তানী মধ্যে কোন প্রকার আপসরফা হওয়া সম্ভব নেই। তিনি আহত পাকসেনাদের ঢাকা থেকে গোপনে পিআই এ’র বিমানে নিয়ে যাওয়ার চাক্ষুষ বিবরণ দিয়েছেন। ঢাকার সামরিক হাসপাতালে আহদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না বলে ঐ নিবন্ধে উল্লেখ রয়েছে। এ দিন থেকে আগরতলা শহরের একাংশে এবং সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত কার্ফু বলবৎ করা হয়।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী