বচ্ছর পাঁচেক আগেকার কথা। আমাগাে বকশী বাজারের ছক্ক মিয়া একবার ফিরিনে’মানে কিনা পশ্চিম পাকিস্তানে গেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানডা যে ‘ফরিন’ এইডা অনেক আগেই টের পাওয়া গেছিলাে। ছক্কু মিয়া পয়লা গেল লাহােরে, হেইখানে যাইয়া দেহে কী? বাঙালিগাে যেই রকম জ্বর বিমারী হইলে রুটী খায়- বাপ মায়ে পােলাপানগাে ভাত দেয় না- হেই রকম হেগাে জ্বর-বিমারী হইলে, ভাত দেয়, আর রুটী খাইতে দেয় না। ছকু অক্করে থঃ- কেইডা কী? একটু খোঁজ লইয়া দেহে কী, বাঙালিরা পেরত্যেক দিন। গােসল করলে কী হইবাে- মছুয়াগুলা টাইম নষ্ট হয় দেইখ্যা এই গােসলের কারবার সারবার অক্করে বাদ দিয়া ফেলাইছে। আত্মীয়-স্বজন আইলে বাঙালিরা বাড়িতে রান্নাবাড়ী কইর্যা খাওয়ায়। কিন্তু পাকিস্তনীগাে কারবারই আলাদা। হেরা আত্মীয়-স্বজন আইলে হােডেলে যাইয়া খাওয়ায়। বাঙালিরা রােজা রাইখ্যা সন্ধ্যার সময় লেমবু সরবত খাইয়া রােজা ভাঙ্গে। কিন্তু লাহুর এলাকার বেড়াগুলা মারীর তৈরী বােতলের পানি খাইয়া রােজা ভাঙ্গে। ছকু অনেক Think কইর্যা বাদশাহী মসজিদে গেল। ওমা অক্করে ধলী। এশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদটার মাইদ্দে দুইচারজন ছাড়া নামাজি পাইলাে না। কেইডা কী? হেষে হুনলে কী! আইজ ঘােড়ার রেইচ খেলা থাকনের গতিকেই নামাজীরা মাঠের মাইদ্দেই রইছে আগাে কাছে নামাজের থনেই হেই কাম বলে বেশি Important। ছক্কু মিয়ার মন খুবই খারাপ হইয়া গেল। কেননা এদ্দিন হুইন্যা আইছে, এগাে কাথাবার্তা না বােঝা গেলে কী হইবাে- এরা বলে আমাগাে ভাই’। ছক্কু বাদশাহী মসজিদে নামাজ আদায় কইর্যা বারাতেই দেখলাে ডাইন দিকে পারসী কবি একবালের মাজার শরীফ। আমাগাে ছক্কু মাজার জিয়ারতের পর আঙ্কা ধান্ধা মাইরা গেল। ইকবালের মাজারের। পিছা মুড়া দিয়া যে রাস্তাডা গেছে, হেই রাস্তাডা অক্করে ইলেকট্রিক লাইট নিওন বাত্তিতে জ্বলমল করতে শুরু করছে। বড় বড় গাড়ি আইস্যা থামছে, আর ভােমা ভােমা সাইজের বেড়াগুলা স্যুট-পেন্ট, সেরােয়ানী-আচকান পিইন্দা হাতে ফুলের মালা লইয়া হড় হড় কইর্যা দালানগুলার মাইদ্দে ঢুকতাছে। দুই কদম আগুয়াইতেই ছক্কর কানে। নাচনেওয়ালীগাে নুপুরের Sound আইলাে। রাস্তার পাশে পানের দোকানে যাইয়া। জিগাইলাে। জবাব পাইলাে এই জায়গারেই ‘হীরামণ্ডি’ কয়। রােজার মাইদ্দে এইখানে
২৪৬
বলে ছিরিয়াল শাে’চলে। করাচী, লারকানা, রাওয়ালপিন্ডির অনেক নেতাই লাহুর অইলে হােডেলের বদলে হীরামন্ডিতেই আইস্যা উডে। এতে বলে একবাল সা’বের কবর। জিয়ারত, বাদশাহী মসজিদে নামাজ পড়ন ছাড়াও এথি ওথি কাজের খুবই সুবিধা হয়।
ছকু লাহুরের মল-এ আইস্যা হাজির হইলাে। বেডায় বড়লুক মাতারীগুলারে দেইখ্যা বার দুই চক্ষু কছলাইয়া গতরের মাইদ্দে চিন্ডী কাটলাে- নাঃ এইডা তাে হপন নাহাঁচাহাঁচিই দেখতাছি। মাইয়ারা দশহাত শাড়ি দিয়া গতর ঢাইক্যা থুইলে কী হইবাে, এইখানকার মাতারীগুলা গতর খালি করণের competition করতাছে। এইখানকার যে দুই চাইরজন মাইয়া সেপ্টিফিন লাগাইয়া শাড়ি পরতাছে, তারা কী সােন্দর এক গজের। মাইদ্দে দুইডা কইর্যা বিলাউস বানাইয়া পেটের চর্বি, আর পিঠের জুইল্যা পড়ন্যা গােস্ত দেখাইতাছে। হেরা হাবেন্ডের পয়সা বাঁচাইতাছে। এরপর ছক্কু মিয়া হুনলাে কী? আমরা। যেমন মক্তব-মাদাসা, স্কুল-কলেজে পােলাপান পাডাই- হেরা লেড়কা-লেড়কীগাে তাহজ্জিব-তমুদ্দন, মানে কিনা আদব-কায়দা শেখানাের লাইগ্যা ‘হীরামণ্ডি’তে পাড়ায়। এলায় কেমন বুঝতাছেন! হেরা ছােটবেলার থনেই কী সুন্দর ট্রেনিং পাইতাছে। কিন্তুক চাপাবাজীতে অক্করে ফাস্ট। চোখে-মুখে খালি ইসলাম, মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাইএইসব কয়। কিন্তুক কামের বেলায়? ইসলামের বারােটা বাজানাে সারা। এইবার বাঙালিগাে রক্ত দিয়া কুলি কইরা এখনও হেরা ভাই ভাই-এর শ্লোগান চালাইয়া যাইতাছে। ছকু হিসাব কইর্যা দেখলাে বাঙালিগাে লগে হেগাে কোনােখাইে তাে মিল নাইক্যা। এমন কী লেখনের টাইমেও বাঙালিরা যেখানে বাঁ দিক দিয়া লেখে, হেইখানে হেতাইনরা ডাহিন মুড়া থাইকা লেখে। বাঙালিরা ভাত খাইলে, হেরা রুটি খায়। বাঙালিরা বনভােজনে গেলে, হেরা নাইট কেলাবে যায়। বাঙালিরা মক্তব্য-মাদ্রাসায়, স্কুল-কলেজে গেলে, হেরা হীরামণ্ডিতে যায়। বাঙালিরা গণতন্ত্র চাইলে, হেরা মেলেটারি ডিক্টেটরশিপ পাইয়া ফাল পাড়ে। বাঙালিরা মনিপুরী সাপুড়ে নাচ দেখলে, হেরা কবীগাে খেমটা নাচ দেহে। বাঙালিরা ভাটিয়ালী-রবীন্দ্রসংগীত শুনলে হেরা কাওয়ালীগজল হােনে। বাঙালিরা পূর্ব, হেরা পশ্চিম। হেই থাইক্যাই ছকুমিয়া হেগাে হাড়ে হাড়ে চিইন্যা ফেলাইছে। বাঙালিগাে ভােগা মারণের লাইগ্যাই হেরা খালি মুছলমান-মুছলমান কইর্যা চিল্লায় আর পবিত্র ইসলামের ভুলমানে বাইর করে। আসলে হেরা ফরিন’-মানে বিদেশ। ইরান, বাহরান, জর্দান, কুয়েতের মতােই বিদেশ। হেগাে আর আমাগাে মাইদ্দে কোনােই Connection নাইক্যা। আমরা, আমরা। তােমরা, তােমরা। এলায় তােমরা রাস্তা মাপবার পারেন। আর যাওনের টাইমে বঙ্গাল মুলুক থাইক্যা আপনাগাে দালালগােও লগে লইয়া যাইয়েন। না অইলে কিন্তুক বিচ্ছুগুলা যে কোনাে টাইমে কাবার কইর্যা ফেলাইবাে।
হ-অ-অ-অ ছক্কু মিয়ার কথা কইতে কইতে আসল কথাই কই নাইক্যা। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ কাগজে হেইদিন অক্করে ভাংডা ফুট কইর্যা ফেলাইছে। ডেইলি টেলিগ্রামের এক সাদা চামড়ার আংরেজ রিপাের্টার বহুত কষ্টে ঢাকার থনে মােটর গাড়ি
২৪৭
লইয়া বাইরাইছিল। মাইল তিরিশেক যাওনের পরেই বেড়ায় দেহে কী, একটার পর একটা গেরামে খালি বাংলাদেশের ফ্লাগ উড়তাছে। আংরেজের বাচ্চায় বুঝলাে মিছা কথা কওনের Competition-এ সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার হের হিটলাররেও Defeat দিছে। আর একজন আংরেজ রিপাের্টার Clare Hollingworth ওয়ার্ল্ড-এর Best পাইটিং পাের্স-এই মছুয়াগুলারে অক্করে হােতায়া ফেলাইছে। Clare লিখুখি ‘বঙ্গাল মুলুকে রেললাইন রাস্তাঘাট নাইক্যা। ইয়াহিয়ার সােলজাররা খুবই খতক অবস্থার মাইদ্দে পড়ছে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলাগাে কারবার দিনদিন জোরদার হইছে। পাকিস্তানী মেলেটারিগাে সংখ্যা কইম্যা গেছে। বিচ্ছগাে মাইর ঠেকাইবার বুদ্ধি পাইতেছে না। এই রিপাের্টার বেশি খুইল্যা কয় নাইক্যা। আপনারাই আন্তাজ কইর্যা লন। গেল ছয় মাসের মাইদ্দে কত হাজার মছুয়া বঙ্গাল মুলুকের কেদো আর প্যাকের মাইদ্দে হাডিড হইয়া আছে। খালি সেপ্টেম্বর মাসের হিসাবেই ষােলশ’ মছুয়া হানাদার আজরাইল ফেরেশস্তার। দরবারে যাইয়া ইয়েচ ছ্যার’ কইছে। ঠ্যাটা মালেকা-পিয়াজীর কী বুদ্ধি! এইসব খবর চাপিস করণের লাইগ্যা রেডিও গাইবী আওয়াজরে অর্ডার দিছে, সমানে এলান করােগজবের খবরে কান দিয়েন না, থুক্কুঃ গুজবের খবরে কান দিয়েন না।
আরে কী মজা কী মজা! ঠেকা কাম চালাইবার জন্যি এইদিকে তিনটেকা রুজ রাজাকার বানাইতাছে। মছুয়াগুলার কামান বিচ্চুগাে হাতে পড়নের গতিকেই ঠ্যাটা। মালেকা কামানের খােরাক হিসাবে রাজাকার বানাইতাছে। হায়রে! রাজাকার কোবাইয়া কী সুখরে! বিক্ষুগুলা কোবায়ে সুখ করলাে। হেইদিন খুলনার দক্ষিণমুড়া ৬০জন রাজাকারের এক লেতা বিক্ষুগুলার কাছে চিঠি লিখছে। আপনাদের আহনের খবরেই আমাদের অবস্থা অক্করে কেরাসিন। আমরা Surrender করতে চাই।’ এলায় কেমন বুঝতাছেন! রাজাকারগাে মাইদ্দে হেই কাম Begin হইয়া গেছে। মুক্ত এলাকায় মওলবী সাবরা আহনের পর হেরা Fall-in হইলাে। হেগাে ছুবেদার কেতে কইর্যা পেরেড করায় হেইডা হােনেন, যখন বাঁশি বা-ইজ-বে, তখন আপনারা পেরতেকে লাইন করি করি দাড়াইবেন। পু-উ-উ। আপনাগাে দাঁড়ানাে হয় নাই। এইভাবে দাঁড়াইবেন। একদল বিজু এই মাজামাদার পেরেড দেখতাছিল। হেরা ফু কইরা হাইস্যা ফেলাইলাে। খালি কইলাে, এইগুলা তাে চুটিয়া-মানে পিপড়া। গেরামের পােলাপানরাই তাে এইগুলার জন্যি যথেষ্ট। রাজাকারগুলা ভড় ভড় কইরা দুইডা খবর কইয়া ফেলাইলাে। মছুয়াগুলা মুক্তি বাহিনীর আওয়াজ পাইলেই ক্যাম্পের মাইদ্দে বইস্যা খালি অর্ডার দেয়, এই রাজাকার লােক, তােমূলােগ যাও, হামলােগ পিছে জায়েঙ্গা। আসলে কিন্তু পিছে জায়েঙ্গা না-পিছে ভাগেংগা। মছুয়াগুলা বিচ্চুগাে ভরে রাইতে বাইরান একদম বন্ধ কইর্যা ফেলাইছে। তাই-ই রােজ রাইতে বিচ্ছগুলার কারবার চলতাছে। এইদিকে আর এক কারবার হুনছেন নি? সাতক্ষীরা, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁ, সুমানগঞ্জ, নােয়াখালী, টাঙ্গাইল-মধুপুর, এসব জায়গায় বাংলাদেশ গবর্ণমেন্টের শাসন কায়েম হইছে। লােকজনের মাইদ্দে ওষুধপত্র, ম্যাচ বাত্তি ও কাপড়-এইসব মালপত্র
২৪৮
দেয়া হইতাছে। এই খবর পাইয়া ঠ্যাটা মালেকা-পিয়াজী নদীর মাইদ্দে দিয়া যাতায়াতের রাস্তা ঠিক রাখনের লাইগ্যা নদীর উপরে কারফিউ দিতাছে। কিন্তুক কোনােমতেই আর সামলাইতে পারছে না। অ্যার মাইদ্দে আবার মছুয়া সােলজাররা কেতে জানি জানতে পারছে, মুক্তি বাহিনীর নৌ আর বিমান বাহিনী Complete হওনের পথে। আর এই ছয়মাস ধইর্যা যে লাড়াই হইতাছে- হেইডা নাকি টেস্টিং কারবার। আসল কাম বলে শীঘ্রি শুরু হইবাে। ব্যাস, পাকিস্তানের সশস্ত্র পুলিশ দল কাইন্দা কইছে, হামলােগ তাে’ লড়াইকো লিয়ে নেহী আয়া, হাম লােগ ল এ্যান্ড আর্ডার কী লিয়ে আয়া। আমরা লড়াই করুম না। এইখানে লড়াই করা আর আজরাইলের লগে পাইট করা একই কথা। আমাগাে বড় ভাই মছুয়া গুলারই যখন ওই জিনিষ টাইট হইছে, আমরা তাে কোন ছার? ঠ্যাটা মালেক্য কী রাগ! লগে লগে রেডিও গায়েবী আওয়াজরে Order দিলাে, কইয়া দেন আমরা জিততাছি, আমাগাে ঠ্যাং কাঁপে না, কাপড় বাসন্তী Colour হয় না, আমরা ভাগােয়াট হই না। ব্যাস লগে লগে রেডিওতে কোরাস শুরু হইয়া গেল। আর থাইক্যা থাইক্যাই জিগির উঠতাছে মুসলমান-মুসলমান ভাই ভাই। কেবা কাহারা দশ লাখ বাঙালি মার্ডার কইর্যা থুইয়া গেছে। কিন্তুক ভাই ঠ্যাটা, বহুত Late কইর্যা ফেলাইছেন। হেরই লাইগ্যা কইছিলাম হেগাে আর আমাগাে মাইদ্দে কোনােই Connection নাইক্যা। আমরা, আমরা তােমরা, তােমরা। আমরা বাঙালিতােমরা মছুয়া। এলায় আপনারা রাস্তা মাপবার পারেন। এখনও টাইম আছে ফুইট্যা পড়েন।