আজ একটা ছােট্ট কাহিনী দিয়ে শুরু করা যাক। সেটা ছিল ১৯৫৪ সাল। আমি তখন ঢাকার ওয়ারী এলাকায় থাকি আর একটা বাংলা কাগজে সাংবাদিকতা করি। প্রথম
৬৪
সাধারণ নির্বাচনের ডামাডােলে সমগ্র পূর্ব বাংলা তখন সরগরম হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায় হাজার কয়েক যুক্তফ্রন্ট কর্মীকে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ। করে বসলাে। কিন্তু তবুও হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী অভিযান অব্যাহত থাকলাে। ঠিক এমনি একটা সময়ে ঢাকার নারিন্দা এলাকায় একটা জনসভায় গিয়ে হাজির হলাম। যুক্তফ্রন্টের সভা। তাই অসংখ্য লােক হয়েছে এ সভায়। একের পর এক বক্তারা সব বক্তৃতা করে গেলেন। এরপর সভা মঞ্চ থেকে ঘােষণা করা। হলাে, আপনাদের মধ্যে কেউ কিছু বলতে চাইলে আসতে পারেন। হঠাৎ করে দেখলাম গলায় মােটা তাবিজ লাগানাে একজন ঢাকাইয়া দ্রলােক দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমার কিছু কওনের আছিল।
সভার উদ্যোক্তারা দ্রলােককে জায়গা করে সভামঞ্চে নিয়ে এলেন। এরপর শুরু হলাে সেই বক্তৃতা। কেন জানি না আজ সতেরাে বছর পরেও এ ঢাকাইয়া ভদ্রলােকের বক্তৃতা মনে রয়েছে। দ্রলােক শুরুতেই বললেন, ভাইসব বাপ-মায়ে লেখাপড়া হিকায় নাই, তাই আপনাগাে মতাে লেখচার দিবার পারুম না। তয় আপনাগাে কিছু মেছাল হুনামু। পাশের লােককে জিজ্ঞেস করে জানালাম ‘মেছাল’ শব্দের অর্থ গল্প। বক্তা বলেই চলেছেন আমাগাে মহল্লার মইধ্যে এক ছ্যামরায় নতুন সাদী করছে। হেই ছ্যামরা অহন হউর বাড়ি যাইবাে। খুব সাইজ্যা-গুইজ্যা রওনা অইছে। যাওনের আগে হের মায়ে কইলাে “দেখ কাউল্যা, হউর বাড়ি যাইতাছােস যা, কিন্তু একটু শরিয়ত মাইনা চলিস্। কাউলা কইলাে ‘আম্মা এই শরিয়তটা কেমন এলায় একটু বুঝায়্যা দেন।’ ‘আবে কাউলা। হেইড্যা বুঝলি না? এই যে কিস্তি টুপি হান দিলাম, এইড্যারে মইরা গেলেও মাথায় থনে ফ্যালাইবি না। এলায় বুঝছস্।
ছ্যামরার হউর বাড়ি আবার গেরামের মইধ্যে। যাওনের টাইমে একটা নদী পার হইতে হয়। কাউল্যা যহন নাও দিয়া নদী পার হইত্যাছিলাে, তহন আঙ্কা মাথার টুপিডা হাওয়ার চোটে অক্করে উড়াল দিয়া পানির মধ্যে পড়লাে। কাউলা তাে মাথায় হাত দিয়া বইলাে- এলায় করি কি? আম্মায় কইছে শরিয়ত ঠিক রাহিস। মাথার টুপিডা য্যান ঠিক থাকে। তাই অনেক চিন্তা করণের পর কাউলার মাথায় এক জব্বর প্ল্যান আইলাে। হে করলাে কি পেন্দনের তপনডা খুইল্যা মাথায় বাইন্দ্যা ফ্যালাইলাে। হের পর ঘাটে নাইম্যা টিনের সুটকেস হাতে লইয়্যা হউর বাড়ি রওনা হইল। এদিকে হইছে কি কাউলার হাউড়ী খিড়কি দিয়া দেখত্যাছে এক পাগলায় মাঠের মধ্যে দিয়া হের বাড়ির দিকে আইত্যাছে। কাছে অওনের পর হাউড়ী অক্করে ভিমড়ি খাইয়া পড়লাে। কি লজ্জা, কি লজ্জা! এইডাতাে পাগলা না- এইড্যা হের দামা। এদিকে কাউলা চিল্লাইতাছে আম্মা আমি কিন্তুক শরিয়ত ঠিকই রাখছি। গতর খালি অইলে কি অইবাে, মাথার মাইধ্যে কাপড় ঠিকই রাখছি।’
নরঘাতক ইয়াহিয়ার এখন কাউলার অবস্থা, গণতন্ত্রকে দলিত-মথিত করে, কয়েক লাখ আদম সন্তানকে নির্বিচারে হত্যার পর যখন বাংলাদেশ শ্মশানে পরিণত হয়েছে,
৬৫
আর মুক্তিফৗজের আন্ধারিয়া মাইরের চোটে যখন হানাদার বাহিনীর নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে আর অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ইসলামাদাদের জঙ্গী সরকারকে উন্মাদ করে তুলেছে, তখন সেনাপতি ইয়াহিয়া ইসলাম, শরিয়ত আর সংহতির বিভ্রান্তিকর শ্লোগানকে সম্বল করে বিশ্বের দরবারে যেয়ে হাজির হয়েছেন। সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্ব ধিক্কারে সােচ্চার হয়ে উঠেছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের নায়ক জল্লাদ ইয়াহিয়া খান এখন ভণ্ডামীর মুখােশ পরে কীটদষ্ট রক্তমাখা নরখাদকের চেহারাটা লুকাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিবেক জাগ্রত হয়ে তথাকথিত পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতির স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে বুলন্দ আওয়াজ তুলেছে, তখন সেনাপতি ইয়াহিয়া পাঁচ লাখ মানুষের কংকাল মাথায় বিশ্বের দরবারে নির্লজ্জ আর বেহায়ার। মতাে এখনাে চেঁচিয়ে চলেছে ‘আমি কিন্তুক শরিয়ত ঠিকই রাখছি- পেন্দনের তপনডা খুইল্যা মাথায় বাইন্দ্যা ফালাইছি। কিন্তু হায় ইয়াহিয়া, তুমি যে একবারে ন্যাংটা। তুম্ আভি একদম ন্যাংগা হ্যায়। তুমহারা শরিয়ত আওর হামলােগকা শরিয়মে আসমান-জমিনকা ফারাক হাে গিয়া হ্যায়। তুম আভি কাউলা বন গিয়া।।