ভারত যুক্ত হলাে
জে এন দীক্ষিত
১৯৭১ সালে জে এন দীক্ষিত ভারত সরকারের উপসচিব পদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক জনসংযােগ বিভাগ ও পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সংকট মােকাবিলাসংক্রান্ত বিশেষ ইউনিটের পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯৩৬ সালের ৮ জানুয়ারি ভারতের চেন্নাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগে যােগ দেন। তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি পররাষ্ট্রসচিব এবং মৃত্যুকালে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জে এন দীক্ষিত তাঁর লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড : ইন্ডাে-বাংলাদেশ রিলেশনস (দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৯৯) বইয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যুক্ত হওয়া থেকে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটনাবলি তথা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশ্লেষণ। করেছেন। নিচে গ্রন্থের স্বাধীনতাযুদ্ধ অংশের কিয়দংশ তুলে ধরা হলাে।
পূর্ব পাকিস্তানের এই জটিল পরিস্থিতিতে (১৯৭১ সালের মার্চ-পরবর্তী পরিস্থিতি) ভারত প্রথমেই যেটা করল তা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের। বিজয় ও সামগ্রিকভাবে ডিসেম্বর ১৯৭০ ও ১৯৭১-এর জানুয়ারি মাসের সাধারণ নির্বাচনে জনগণের বৈধ আকাঙ্ক্ষার প্রতি পরিষ্কার সহানুভূতি প্রদর্শন করা। সামরিক আক্রমণ ও শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের পরপরই আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ভারতে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠনের জন্য ভারতের সহায়তা কামনা করেন। প্রথমত, ভারত বাংলাদেশকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করার সুযােগ দেয়। দ্বিতীয়ত, বাঙালি সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর যে সদস্যরা
পৃষ্ঠা: ১৯০
ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন, ভারত তাঁদের আশ্রয় দেয়। কারণ, ২৫ মার্চ টিক্কা খানের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সামরিক অভিযানে এঁদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছিল। ৩. পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা ও বাছবিচারহীন সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ, বিশেষ করে সামরিক সদস্যরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের মে মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কটি যােদ্ধা বাহিনী গড়ে ওঠে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয় সদস্যরা মেজর জিয়াউর রহমান ও সে সময়ের জ্যেষ্ঠতম সাবেক সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে প্রতিরােধযুদ্ধ শুরু করেন। জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন, তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব সংগঠনের কর্মীরা শেখ ফজলুল হক মনি (শেখ মুজিবের ভাগনে), ‘টাইগার’ কাদের সিদ্দিকী, তােফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল কুদুস মাখন প্রমুখের সাহসী নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। এই গােষ্ঠীর সামরিক প্রশিক্ষণ বা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও অগ্রাধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। তাঁরা জানতেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই প্রতিরােধযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে টাকা ও অস্ত্র।
ওদিকে সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনকে স্থিতিশীল না করে চরম সহিংস সামরিক নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের নিচের স্তরের কর্মকর্তারা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসা ও বাংলাদেশ গঠনের আহ্বানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে প্রতিরােধযােদ্ধারা ঢাকার বাইরের অধিকাংশ অস্ত্রাগার দখল করে নেন। তারা বিভিন্ন জেলা ও মহকুমার অর্থভান্ডারও দখল করে নেন। এসব টাকা হস্তগত করে তারা ভারত সরকারের সহায়তা চান, যাতে এসব টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত করে যােগাযােগের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও যুদ্ধের রসদ কেনা যায়। ভারতীয় গােয়েন্দারা দখল করা অর্থকে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরে সাহায্য করেন, যা প্রতিরােধযােদ্ধারা যােগাযােগসামগ্রী আর অস্ত্র ক্রয়ে ব্যবহার করেন।
১৯৭১ সালের মে মাসের মধ্যভাগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলােতে আসা শরণার্থীর সংখ্যা মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫ থেকে ৭০ লাখের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার জনসংখ্যার ওপর চাপ পড়ে। চাপ পড়ে এসব রাজ্যের সম্পদের ওপরও। ভারত পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক লক্ষ্যের প্রতি সাধারণ সমর্থন জানালেও স্বাধীনতাসংগ্রামের সমর্থনে বৃহৎ পরিসরে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ
পৃষ্ঠা: ১৯১
নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিল। ভারত মুজিবনগর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় নানাভাবে সহযােগিতা করলেও এবং প্রতিরােধ আন্দোলনকে সাধারণভাবে সমর্থন জানালেও এই সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। এ বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর স্রোত সামলানাের জন্য ইন্দিরা গান্ধী একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খােলার নির্দেশ দেন। এর দায়িত্ব দেন ভারত সরকারের তৎকালীন পুনর্বাসন সচিবকে।
ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়টিকে প্রথমত শরণার্থী সমস্যা হিসেবে জাতিসংঘে উত্থাপন করে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ও জেনেভায় নিযুক্ত ভারতীয় দূতকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা ইসিওএসওসি [ইকোনমিক অ্যান্ড সােশ্যাল কাউন্সিল) ও ইউএনএইচসিআরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলােতে পূর্ব পাকিস্তানের সহিংস পরিস্থিতি, তার নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলােতে যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জনসংখ্যাগত চাপ সহ্য করতে হচ্ছে, সে বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পেশ করেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ভারতের দূতাবাসগুলােকে সংশ্লিষ্ট দেশের সমর্থনলাভে সচেষ্ট হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতিটা ছিল এ রকমই। কিন্তু কীভাবে এ সংকট মােকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ে নানা মতবিরােধ ছিল। ফলে ইন্দিরা গান্ধী এ সমস্যা মােকাবিলায় তার উপদেষ্টাদের মূল দলের মধ্য থেকে কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারত সরকারের পলিসি প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার, পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের পরিচালক আর এন কাও এবং প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব পি এন ধর। মন্ত্রীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শরণ সিং, ওয়াই বি চ্যাবন ও জগজীবন রাম।
পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা কীভাবে মােকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে ভারত সরকারের ভেতরে যে চিন্তাভাবনা চলছিল, সে বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। আমি মূলত ডি পি ধর এবং টি এন কাউলের কাছ থেকে যে নির্দেশনা পেতাম, স্মৃতি থেকে সে সম্পর্কেই লিখছি। আমি তখন ছিলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ-বিষয়ক বিভাগের উপসচিব, আমার কাজ ছিল জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলাের কাজ তদারক করা। এই সূত্রেই পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়ি। ভারত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী সমস্যাটির প্রচারণা দিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন স্তরে উত্তেজনা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ফলে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে আমাকে এর সমন্বয়কারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালের জুনের
পৃষ্ঠা: ১৯২
শেষের দিকে আমি জাতিসংঘ বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এ সময় পূর্ব। পাকিস্তানের সমস্যা মােকাবিলায় একটি বিশেষ ইউনিট বা ব্যুরাে গঠন করা হয়। আমি মূলত পজিশন পেপার ও বেসিক পলিসি নােটস নিয়ে কাজ করছিলাম আর সংকটের হালনাগাদ অবস্থা লিপিবদ্ধ করছিলাম। ডি পি ধর এবং টি এন কাউল যেসব বৈঠকে অংশ নিচ্ছিলেন, আমাকে তার ভিত্তিতে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্যমান পরিস্থিতি-সংক্রান্ত ভারতীয় নীতির ব্যাপারে যে মতভেদ রয়েছে, তার সম্পর্কে আমি কিছু জানতে পারি।
ইন্দিরা গান্ধী স্বাভাবিকভাবেই মনে করতেন, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং তাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে পূর্ণাঙ্গ সামরিক সহায়তাও দেওয়া প্রয়ােজন। তাঁর প্রাথমিক চিন্তাও ছিল এটি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংও মনে করতেন, ভারতকে শেষমেশ হয়তাে তা-ই করতে হবে; কিন্তু তার আগে ভারতের কাজের বিশ্বাসযােগ্যতা ও রাজনৈতিক সঠিকতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে না পারে। শরণ সিং ভেবেছিলেন, ভারতকে যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে পরাশক্তিসহ জাতিসংঘের চাপ সহ্য করতে না হয়। অর্থাৎ ভারত পাকিস্তান ভেঙে ফেলা ও তার ভৌগােলিক অখণ্ডতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে সেখানকার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে—সম্ভাব্য এমন অভিযােগের ভিত্তিতে যেন কেউ তাঁর ওপর চাপ দিতে না পারে। যত দূর মনে পড়ে, পি এন হাসার এই মত পােষণ করতেন। অন্যদিকে ডি পি ধর। তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানে হামলার পক্ষপাতী ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ও সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল (পরবর্তীকালে ফিল্ড মার্শাল) মানেকশর পরামর্শ নিয়েছিলেন। শােনা যায়, তখন তারা বলেছিলেন, ভারত সামরিক অভিযানে যেতে পারে, কিন্তু গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে তাড়াহুড়া করে সামরিক আক্রমণ শুরু করলে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এতে অভিযানের সফলতা পেতে দেরি হবে। জেনারেল মানেকশ বলেন, যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য তাঁকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। কারণ, তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের দুটি ফ্রন্টেই তাদের যুদ্ধ করতে হবে। ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টারাও এ মত দেন যে ভারতের উদ্যোগের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমর্থন না পাওয়া পর্যন্ত চীনের ব্যাপারটা বিবেচনা করতে হবে। এমন সম্ভাবনা আছে। যে চীন পাকিস্তানকে সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সহায়তার বাইরে পাকিস্তান চীনের সহায়তা পেতে পারে। ফলে ভারত এক পরিকল্পিত নীতিগত অবস্থান নেয়, অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও যদি পূর্ব পাকিস্তানের সংকট মােকাবিলা করা না যায়,
পৃষ্ঠা: ১৯৩
তাহলে সামরিক হস্তক্ষেপ করারও সুযােগ থাকবে। ভারতের নীতিগত অবস্থানের মূল বিষয়গুলাে ছিল এ রকম : ও পাকিস্তান যদি সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল এবং জনগণের, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের, আইনসম্মত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেয়, তাহলেই শুধু পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান হতে পারে। এই লক্ষ্য অর্জনে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দেওয়া, যাতে তিনি ঢাকায় ফিরতে পারেন এবং তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনা শুরু করতে পারেন। পাকিস্তানের উচিত হচ্ছে সব শরণার্থীর ঘরে ফেরা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তা, সম্মান ও অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নির্যাতন বন্ধ করা। পাকিস্তানি সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে ও প্রভাবিত করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান সংকটের সমাধান করা। এই চাপ নিশ্চিত করতে হবে জাতিসংঘ ও দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে।
পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আক্রমণের কারণে যেসব মানুষ ঘরছাড়া হয়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের পুনর্বাসনে জাতিসংঘ ও তার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলাের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তারপর পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে।
ভারতের এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সেই পরিচিত দোষারােপের রাজনীতি শুরু করে। তারা অভিযােগ করে, ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে নাক গলিয়ে দেশটি ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে। শেখ মুজিবকে নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দেওয়া বা তার সঙ্গে পুনরায় আলােচনা শুরু করার ব্যাপারে পাকিস্তান কোনাে প্রকার সাড়া দেয়নি। পাকিস্তান এ কথাও প্রচার করতে শুরু করে, ভারতে যে। শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে, তারা আসলে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারী’, ধর্মীয় পরিচয়ের দিকে থেকে যাদের সিংহভাগই হিন্দু। তারা অভিযােগ করে, ভারত বাংলাদেশের নির্বাসিত সরকার ও তাদের বিরােধী শক্তিকে সমর্থন দিচ্ছে। এদিকে জুলাই মাসের মধ্যে ভারতে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা ৮০ লাখ হয়ে যায়। পাকিস্তান যে তার যুদ্ধংদেহী অবস্থান থেকে সরে আসবে, তেমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছিল না। ফলে ভারত সরকারের মনে ক্রমেই এ প্রত্যয় সৃষ্টি হতে থাকে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়া ছাড়া তাদের আর কোনাে উপায় নেই।
পৃষ্ঠা: ১৯৪
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষে ভারত বুঝে যায়, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার মতাে অবস্থানে নেই। এই সংকটের পর পাকিস্তানের নীতির সাধারণ রূপটি ছিল এ রকম, যেটা মূলত এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে :
• শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার ও ফাসি হবে। এরপর রায় সংশােধন করে তাঁকে দীর্ঘ মেয়াদে সাজা দেওয়া হবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি আর কেউকেটা প্রকৃতির কিছু না হয়ে ওঠেন।
• স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপরীতে পাকিস্তানকে বাইরের সমর্থন লাভ করতে হবে। এর জন্য সম্ভাব্য যে যুক্তিটি সে ব্যবহার করবে সেটা হলাে, পাকিস্তান সরকার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বায়ত্তশাসনের নামে দেশটিকে খণ্ডিত হতে দিতে চায় না।
• পাকিস্তান সব মুসলিম শরণার্থীকে ফেরত নেবে। কিন্তু যে হিন্দুরা সামরিক আক্রমণের মুখে ভারতে পালিয়ে গিয়েছে, তাদের ফেরত নেওয়া হবে না।
• এমনকি তাদের ফেরত আনার ব্যাপারটাও শর্তাধীনে সম্পন্ন হবে : জাতিসংঘ ও পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলােকে তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হবে।
• পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হবে। তাদের আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।
• পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর না দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে (২৮ জুন ১৯৭১ ইয়াহিয়া খানের ঘােষণা অনুসারে)। প্রস্তাবিত সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে আংশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। এই সংবিধান অনুসারে, পূর্ব পাকিস্তানের সব রাজনীতিক সরকার পরিচালনায় অংশ নিতে পারবেন, শুধু যারা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের ভাঙন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তাঁরা ছাড়া (আওয়ামী লীগের যে নেতারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জিতেছিলেন, তারাও এর মধ্যে পড়বেন)।
• পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন বহাল থাকবে। পরিস্থিতি পুরােপুরি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত সামরিক অভিযান চলবে। ১৯৭১ সালের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বেসামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে।
• ভারত যে স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা করছে, সেটাকে পাকিস্তানের একতাবিরােধী নাশকতামূলক কাজ হিসেবে দেখতে হবে। জাতিসংঘের সাধারণ ও নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে এই বিষয়গুলাে শান্তির জন্য হুমকি হিসেবে উত্থাপন করা হবে। ভারতকে অভিযুক্ত করা হবে।
পৃষ্ঠা: ১৯৫
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে ভারতের বাংলাদেশকে সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারটা সামাল দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষা সহযােগিতা চুক্তি করা হবে। একই সঙ্গে, ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে আরও বৃহত্তর আন্তর্জাতিক বিরােধিতার সুযােগ সৃষ্টি করা হবে। আশা করা হচ্ছিল, পাকিস্তান এই সমীকরণ মেলাতে পারলে ও সামরিক , অভিযান চালিয়ে যেতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে পুননিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারবে। এতে পাকিস্তানের ভঙ্গুর একতা রক্ষা করা সম্ভব হবে।
এস কে সিং এবং আমি সেপ্টেম্বরের শেষ ও অক্টোবরের শুরুর দিকে কলকাতা সফর করি। আমরা যৌথভাবে ডি পি ধরের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করি। সেখানে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখিয়েছি, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্রমশ মুক্তিযােদ্ধাদের নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর এই দলগুলাের মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন, যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমানসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুযােগ্য কর্মকর্তারা। আমার যত দূর মনে পড়ে, আমাদের মূল্যায়ন এ রকম ছিল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭২ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে এই প্রতিরােধযুদ্ধ দমন করতে পারে, যদি ভারত যুদ্ধে গুণগত সহায়তার পরিমাণ না বাড়ায়, তাতে আরেকটি ভারতপাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা থাকলেও। এ সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমি যে পজিশন পেপার প্রস্তুত করেছিলাম, তাতে নিম্নোক্ত বার্তাগুলাে ছিল : ১. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ব্যাপারে দোদুল্যমান অবস্থান নিয়েছে। ২. এতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবনে যে দুর্দশা নেমে আসবে, সে বিষয়ে কোনাে হতাশা বা উদ্বেগ থাকবে না। ৩. পাকিস্তান সরকার যদি পরিস্থিতি স্থিতিশীল করে ফেলতে পারে, তাহলে পৃথিবী তা মেনে নেবে ও পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করবে। ৪. ভারত যদি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশ ও চীন শুধু তাকে পুরােপুরি রাজনৈতিক সমর্থনই দেবে না, তাকে গােপনে সামরিক সহায়তাও দেবে। কিন্তু তারা হয়তাে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না। ৫. মুসলিম দেশগুলাে সাধারণভাবে পাকিস্তান সরকারকে রাজনৈতিক সমর্থন দেবে। কিন্তু তারা পাকিস্তানকে বড় ধরনের অর্থবহ সহায়তা দেবে, সেটা হয়তাে নয়। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট বিষয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের
পৃষ্ঠা: ১৯৬
সদস্যদেশগুলাে হয়তাে একই মনােভাব গ্রহণ করবে না। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তাে বহুধাবিভক্ত। তারা হয়তাে কেউ কেউ উভয় পক্ষকেই মৃদু তিরস্কার করবে। আর সিংহভাগ পাকিস্তানের ভূখণ্ড রক্ষার গুরুত্বের এ দাবিতে সমর্থন দেবে। ৬. ভুটান ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলাের হয়তাে ভারতের আরেকটি প্রতিবেশী রাজ্যে সরাসরি হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আপত্তি থাকবে। কারণ, ভারতের ব্যাপারে তাদের বাস্তব বা কাল্পনিক হুমকির ভীতি রয়েছে। ওদিকে কৌশলগত কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও চীন-পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া ভারতের পদক্ষেপে সমর্থন দেবে।
পরিস্থিতির সাধারণ মূল্যায়ন হিসেবে আমি এ কথাও বলেছিলাম, রাশিয়া ভারতের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হলেও যুদ্ধ বা দ্বন্দ্ব-সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদ সফলতার সঙ্গেই এতে হস্তক্ষেপ করবে। শেষে সাধারণভাবে বলেছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে কখন, কীভাবে ও কী দিয়ে আমরা সহায়তা করব, তার জন্য গােয়েন্দা সংস্থা ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা যদি বলে, খােলাখুলি সমর্থন দিলে স্বল্প মেয়াদে সফলতা লাভ করা যায়, তাহলে ভারত সেটা বিবেচনা করে দেখতে পারে। আর তারা যদি ইঙ্গিত দেয় যে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে, তাহলে যুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে ভারতকে আরও সতর্ক হতে হবে।
এর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকাজ চলছিল। সব লক্ষণ দেখেই মনে হচ্ছিল, তাকে খুব কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। ইন্দিরা গান্ধী নভেম্বর মাসের দিকে বিশ্বভ্রমণ শুরু করেন, যে সময় তিনি মস্কো, ওয়াশিংটনসহ পশ্চিম ইউরােপের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর সফর করেন। এর আগে মধ্য অক্টোবর থেকেই ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুণগত সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও নৌ ইউনিটকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়, পাছে পাকিস্তান ভারতের ভূখণ্ডে হামলা চালায়। নিক্সন খুব স্বাভাবিকভাবেই এটা জানতেন। তিনি ইতিমধ্যে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মধ্য থেকে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ’ গঠন করেছেন, যার লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সংকট মােকাবিলা করা। নিক্সন সােভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তিনি হেনরি কিসিঞ্জারকে বলেন, তিনি যেন ওয়াশিংটনে নিযুক্ত সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যােগাযােগ করে রাশিয়াকে চাপ দেন, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতকে এই যুদ্ধে সহায়তা করা থেকে বিরত রাখে। সােভিয়েত ইউনিয়ন বেশ কৌশলী উত্তর দেয়, যদিও নিজ অবস্থানে তারা খুব দৃঢ় ছিল। গ্রোমিকো ২৯ সেপ্টেম্বর নিক্সনকে বলেন, উপমহাদেশে যুদ্ধ এড়ানাে কাক্ষিত ব্যাপার হলেও
পৃষ্ঠা: ১৯৭
সােভিয়েত ইউনিয়নের মূল্যায়ন হচ্ছে, যুদ্ধের ঝুঁকি ‘পাকিস্তানের প্ররােচনা ও অনমনীয় মনােভাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। অক্টোবরের শুরুর দিকে কিসিঞ্জারের ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর আলেকজান্ডার হেইগকে নিক্সন বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, বিপরীতে পাকিস্তানও তাদের বাহিনীকে সরিয়ে আনবে—এ প্রস্তাবে রাজি করানাের জন্য ভারতকে পুনরায় চাপ দাও।’ মার্কিন সিনেট ও হাউস অব রেপ্রেজেনটেটিভ উভয়েই একইভাবে নিক্সন প্রশাসনের পাকিস্তান ঝোঁকের ব্যাপারে সমালােচনামুখর ছিল। নিক্সন ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, যেনতেন প্রকারেই হােক, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন দেওয়া। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানকে উৎসাহিত করা হয়, তারা যেন রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কিছু দাবি তােলেন, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক দাবি আমলে নেওয়া হবে না। এ কাজ করার জন্যই পূর্ব পাকিস্তানে সংকট সৃষ্টি হয়।
আগেই উল্লেখ করেছি যে অক্টোবর মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক জনসংযােগ বিভাগের পরিচালক ও পূর্ব পাকিস্তানের সংকট মােকাবিলাসংক্রান্ত বিশেষ ইউনিটের পরিচালক হিসেবে আমি কলকাতায় যাই। আমাদের এই কলকাতা সফরের লক্ষ্য ছিল, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের শাখা সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করা, যাতে এটা বােঝা যায়, ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম কত দিন টিকতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দীনের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা আমাদের জানান, গেরিলাযুদ্ধ অনেক দিন চালানাে সম্ভব হলেও এই মুক্তিযােদ্ধারা ভারতের সহায়তা ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাধিকারবলে কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, ভারতের সহযােগিতা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই তরুণদের লড়াইয়ের কোনাে আশা থাকবে না, যেটা শেষমেশ হারিয়ে যেতে পারে। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন, যত দ্রুত সম্ভব।
প্রবাসী মুজিবনগর সরকার ভারতীয় সরকারের কাছে নিচের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবগুলাে উপস্থাপন করে:
• বাংলাদেশকে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আইনগতভাবে স্বীকার করে নিতে হবে।
• পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালানাের জন্য ভারতীয় ১ সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ কমান্ড গড়ে তুলতে হবে।
পৃষ্ঠা: ১৯৮
• জাতিসংঘের কাছে ভারত সরকারকে এটা পরিষ্কার করতে হবে যে তার বিভিন্ন সদস্যের গড়িমসি সত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশ তাদের এমন কোনাে হস্তক্ষেপ মেনে নেবে না, যার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম দুর্বল হয়ে পড়ে বা পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করতে হয়।
ওয়াশিংটন থেকে ফিরে এসে ইন্দিরা গান্ধী এই দাবির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেন। আমাদের গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে নিশ্চিত খবর দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীতে নানা তৎপরতা শুরু করেছে, তারা পূর্ব পাকিস্তানের সংকট মােকাবিলায় ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর পরিকল্পনায় সায় দেবে। সে কারণে ভারত সিদ্ধান্ত নেয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সমর্থনে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আরও সহায়তা দেওয়া হবে। ওদিকে মুক্তিবাহিনী সারা বাংলাদেশে আরও অভিযান চালায়। ফলে পাকিস্তান বাহিনীর মধ্যে কিছুটা মরিয়া ভাব সৃষ্টি হয়। মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিটি অভিযান চালানাের পর ভারতে আশ্রয় পেতেন। সে কারণে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ভারতের ভেতরে বিমান হামলাসহ নানা অভিযানের পরিকল্পনা নেয়, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের কাছে তখন ১২ থেকে ১৪টি বিমান ছিল।
নভেম্বরের ১৫ থেকে ৩১ তারিখের মধ্যে ভারতীয় সেনারা প্রতিশােধ নিতে শুরু করলে সংকট সৃষ্টি হয়। ২২ নভেম্বর বয়রায় যে যুদ্ধ হয়, সেটি ছিল আসলে ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের সূচনা। ইয়াহিয়া খান ইসলামাবাদ থেকে ভারতকে হুমকি দেন, তারা যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন দেওয়া না থামায়, তাহলে এ যুদ্ধ শুধু পূর্ব ফ্রন্টেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভারতকে পশ্চিম সীমান্তে এর পরিণতি বরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা ও মুক্তিসংগ্রামে আরও সহায়তা দেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা আঁচ করতে পেরে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। সােভিয়েত ইউনিয়নকেও অস্ত্র সরবরাহের অনুরােধ করা হয়। তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুরােধে সাড়া দেয়। মধ্য অক্টোবরের মধ্যে ভারতে সােভিয়েত সামরিক সহায়তা আসতে শুরু করে। বয়রার যুদ্ধের পরই ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আইনি ও পদ্ধতিগত সহায়তার সব বন্দোবস্ত করে ফেলে। দিল্লি থেকে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের একটি অগ্রগামী দল কলকাতায় যায়। আমার যত দূর মনে পড়ে, সময়টা ছিল নভেম্বরের ২৮ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে। যৌথ কমান্ড গঠনের লক্ষ্যে ভারত ও মুজিবনগর সরকারের মধ্যে একটি খসড়া মতৈক্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তারা সেখানে যায়। এ সিদ্ধান্তও হয় যে কমান্ড গঠনের পর অভিযান শুরু হলে ইন্দিরা গান্ধী
পৃষ্ঠা: ১৯৯
বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবেন। ডিসেম্বরের ১ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত মিসেস গান্ধী কংগ্রেসদলীয় কিছু কর্মকাণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যােগ দিতে কলকাতায় অবস্থান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা বিষয়ে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেওয়া এবং পরে তাতে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সাধারণ মতৈক্য থাকলেও নভেম্বরের শেষের দিকে যৌথ কমান্ড গঠনের ব্যাপারটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় সেনা কমান্ড এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি তুলে ধরে। ভারতীয় বাহিনী একটি প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযানে অংশ নেবে বলে সেনা কমান্ড একটি সমন্বিত কেন্দ্রীভূত চেইন অব কমান্ড গঠনের প্রয়ােজনীয়তার কথা বলে। জেনারেল (এ কাজের জন্যই তাকে পদটি দেওয়া হয়) ওসমানীকে যৌথ কমান্ডের জয়েন্ট সুপ্রিম কমান্ডার ঘােষণা করায় আমাদের সেনাবাহিনীর উচ্চ কমান্ড খুব একটা খুশি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন মনে করেন, তাঁর সরকারের রাজনৈতিক বিশ্বাসযােগ্যতা এবং মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের শৃঙ্খলা ও আনুগত্য বজায় রাখতে হলে কর্নেল (অব.) ওসমানীসহ মুক্তিবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের যৌথ কমান্ডের উচ্চপদে রাখতে হবে। শেষমেশ ইন্দিরা গান্ধীর পীড়াপীড়িতে ডি পি ধর ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চ কমান্ডকে এ প্রস্তাবে রাজি করান যে ওসমানী ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার সমান্তরালে থেকে কাজ করবেন। ১৯৭১ সালের ১ থেকে ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে যৌথ কমান্ড গঠনের সমঝােতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ভারত জানত, তারা একবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে মূল কাজটি তাদেরই করতে হবে। মুক্তিবাহিনী হয়তাে দেশের ভেতরে প্রশাসন ও যােগাযােগব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পারবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অংশের সমন্বয় ভেঙে দিতে পারবে। তবে এটাও পরিষ্কার ছিল যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এর নেতৃত্ব দিল্লি ও কলকাতায় সামরিক সদর দপ্তরের হাতেই থাকবে। যৌথ কমান্ড আসলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও সংবেদনশীলতার প্রতি সম্মান রেখেই গঠন করা হয়। প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে সেই অক্টোবরেই। সে সময়ই ভারতীয় কমান্ডাে ও মেরিন সেনারা নানা দলে ভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢােকা শুরু করেন। তারা আসলে বিশেষায়িত দক্ষতা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অভিযানে পেছন থেকে সমর্থন জুগিয়েছেন।
পৃষ্ঠা: ২০০
প্রশিক্ষিত ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতিতে গেরিলাযুদ্ধের কার্যকারিতা বেড়ে যায়। ভারতের সামরিক সমন্বয় কর্মকর্তারা বিচ্ছিন্ন যােদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি ও তাঁদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিবাদ নিরসনেও ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে অনেক গ্রুপই স্বতন্ত্রভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। টাইগার কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে এ রকম একটি দল ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে ছিল আরেকটি দল। এর সঙ্গে সাবেক সামরিক, আধা সামরিক, পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যই জেনারেল ওসমানী ও মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) নেতৃত্বে যুদ্ধ করছিলেন।
৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যেই মিসেস গান্ধী কলকাতায় তার কাজ সারেন। একটি বিশেষ উড়ােজাহাজে তিনি দিল্লির উদ্দেশ্যে কলকাতা ছাড়েন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বা সাতটায়। তার সঙ্গে ছিলেন ডি পি ধর, পশ্চিমবঙ্গের দুএকজন রাজনীতিক এবং আমার ও পিটার সিনাইয়ের মতাে মধ্যপর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা, যারা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করেন। এ বিমানটি লক্ষ্ণৌয়ের কিছুটা পূর্বাকাশে পৌছালে পাইলট ডি পি ধরের কাছে এসে বলেন, তাঁকে একবার ককপিটে যেতে হবে। কারণ, দিল্লি থেকে একটি জরুরি বার্তা এসেছে, ধর সাহেবকে একটু কথা বলতে হবে। তিনি তিন থেকে চার মিনিট ককপিটে অবস্থান করে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে নিজের আসনে ফিরে এলেন। এরপর আমাদের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ‘যা ধারণা করা হয়েছিল, বােকাটা ঠিক তা-ই করেছে।’ তিনি বললেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জম্মু, পাঞ্জাব ও রাজস্থানের বিমানঘাঁটিতে যুদ্ধপূর্ব অতর্কিত বিমান হামলা চালিয়েছে। তিনি আরও বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভারতের ভূখণ্ডেও হামলা চালিয়েছেন। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ইতিমধ্যে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছেন। পাকিস্তানের বিমান হামলার আশঙ্কায় ভারতের উত্তর ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায়ই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে [অন্য সূত্র অনুযায়ী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতাতেই যুদ্ধ শুরুর সংবাদ জানতে পারেন]।
দিল্লিতে অবতরণের বদলে মিসেস গান্ধীর বিমান লক্ষ্ণৌয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুই ঘণ্টার মতাে অপেক্ষা করার পর রাত ১০টার দিকে আমাদের বিমান লক্ষ্ণৌ ছেড়ে যায়। আমরা ১০টা ৪৫ মিনিটে পালামে অবতরণ করি। বিমানবন্দরে মিসেস গান্ধীকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম অপেক্ষা করছিলেন। আমরা সবাই সেখান থেকে সরাসরি দক্ষিণ ব্লকে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে চলে যাই। মিসেস গান্ধী,
পৃষ্ঠা: ২০১
জগজীবন রাম, শরণ সিং ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি অপারেশন রুমে প্রবেশ করেন। জেনারেল মানেকশ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে পাল্টা আক্রমণ হিসেবে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা মিসেস গান্ধী ও তার মন্ত্রীদের অবহিত করেন। তিনি পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ শুরু করার জন্য মিসেস গান্ধীর অনুমতি চান, প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দেন। এরপর মিসেস গান্ধী মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে সভাপতিত্ব করার জন্য দক্ষিণ ব্লকের পশ্চিম শাখার মন্ত্রিপরিষদকক্ষে যান। বৈঠকটি তিনি বিমানে থাকাকালে আহ্বান করেছিলেন। মন্ত্রিসভায় অবিলম্বে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘােষণা, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া ও নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন চালু করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৪ ডিসেম্বর সকালে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের সেনারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করে। ভারতীয় নৌ ও বিমানবাহিনীকে অবিলম্বে আক্রমণ শুরু এবং পাকিস্তানের জাহাজ ও বিমান চলাচল বাধাগ্রস্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৫ ডিসেম্বর মিসেস গান্ধী ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ঘােষণা দেন। সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে তা অনুমােদন করে এবং সামরিক অভিযানের প্রতিও অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। পূর্ব পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত বাংলাদেশের সর্বজ্যেষ্ঠ কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ভারতে বাংলাদেশের প্রথম চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। তাঁর মর্যাদা স্বীকৃত হয় এবং সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার মতাে বিরল সম্মানও লাভ করেন তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অংশগ্রহণের সমর্থন আদায়ে ভারত কূটনৈতিক তৎপরতাও শুরু করে। ভারত কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের তরফ থেকে সংকটের পূর্বাপর ব্যাখ্যাসহ সব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের কাছে বার্তা পাঠানাে হয়।
ক্রমবর্ধমান এই সংকট মােকাবিলায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি অধিবেশন ডাকা হয় ৪ ডিসেম্বর। জাতিসংঘে পাকিস্তানের দূত আগা শাহি যুক্তরাষ্ট্রের দূত জর্জ বুশ ও চীনা দূত হুয়াং হুয়ার সমর্থনে দাবি করেন, নিরাপত্তা পরিষদ যেন ভারতের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়। সােভিয়েত দূত জ্যাকব মালিক ভারতকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। তিনি ভারতের পদক্ষেপের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। নিরাপত্তা পরিষদ ভারতপাকিস্তান তৃতীয় যুদ্ধের বিষয়ে তার গভীর চিন্তার কথা জানালে ভারতীয় দূত সমর সেন ৪ ডিসেম্বর পরিস্থিতির সারসংক্ষেপের সঙ্গে ভারতের প্রত্যয়ের কথা
পৃষ্ঠা: ২০২
জানান, ‘কেউ প্রস্তাব পেশ করে বা অনুরােধ করে আমাদের পথ থেকে দূরে সরাতে পারবে না। যে যুদ্ধবিরতির কথা আমি ইতিমধ্যে বলেছি, তা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়। সেটা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে। ফলে এ ব্যাপারে বেশি অগ্রসর হওয়ার আগে আমাদের তাদের কথা শুনতে হবে।’
অনুবাদ : প্রতীক বর্ধন
পৃষ্ঠা: ২০৩
Ref: ১৯৭১ শত্রু ও মিত্রের কলমে সম্পাদনা মতিউর রহমান