জেলখানার বধ্যভূমি ও গণকবর
বিষখালী নদী তীরে হত্যাকাণ্ডের সময় পাথরঘাটার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লক্ষণ দাস, তার ছেলে কৃষ্ণ দাস, অরুণ দাস ও স্বপন দাসকে ধরে এনে বরগুনা কারাগারে আটক রাখা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থানের কারণে সাবেক সিও আতিকুলাহ, এস আই আবদুল মজিদ, সিপাহী আড়ি মিয়া ও আবদুল জব্বারকে পটুয়াখালী নিয়ে হত্যা করা হয়।
এর ফলে বরগুনা শহর লোকশূন্য হতে থাকে। এসময় পাকবাহিনীর সহযোগীরা ঘোষণা দেয়, বর্ণ হিন্দুদের কিছুই বলা হবে না। পাকবাহিনী তখন বরগুনা ছেড়ে পটুয়াখালী চলে যায়। এতে বিশ্বাস করে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বরগুনা শহরে ফিরে আসে। ২৬ মে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন সাফায়াত চারজন সহযোগী নিয়ে গোপনে বরগুনা আসে। পরদিন সকালে ২/৩ জন করে লোক ধরা শুরু করে। লোকজন আবার পালাতে শুরু করে। তখন পাক সেনারা দোনকার ইমাম হোসেনের মত সহযোগীদের নিয়ে নাথপাড়া, পশ্চিম বরগুনা ও শহর এলাকা ঘেরাও করে শতাধিক নারী পুরুষকে বেঁধে কারাগারে ঢোকায়। পাকবাহিনীর সদস্য ও তাঁদের সহযোগীরা সিএন্ডবি’র ডাকবাংলোকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। রাতে অনেক নারীকে জেলখানা থেকে সেখানে নিয়ে গণধর্ষণ করে আবার সকালে কারাগারে ফেরত পাঠায় তারা। পঞ্চাশোর্ধ এক বিরঙ্গণা বলেন, “তখন তার বয়স ১২/১৩ বছর। সেদিন তাকেও সেখানে নিয়ে পাক সেনারা নির্যাতন চালিয়েছিল। সকাল বেলায় আবার জেলখানায় পাঠানো হয়”। তিনি জানান, তার মতো ১৪/১৫ জন নারী সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়। যাদের অনেকে ভারতে চলে গেছেন আবার অনেকে দেশেই আছেন।
২৮ মে পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ বরগুনায় আসে এবং ২৯ মে বরগুনা জেলখানায় প্রহসনমূলক বিচারের করে গণহত্যা শুরু করে। কারাগারের উত্তর-পশ্চিম পাশে বরগুনা জেলা স্কুল অবস্থিত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ছাত্ররা স্কুলে এসেছিল। ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বরগুনা কারাগারে তখন গণহত্যা। প্রথম দিন ৫৫ জনকে হত্যা করে তারা। অনেকে সেদিন গুলি খেয়ে আধা মরা অবস্থায় পড়ে ছিল। কিন্তু তাদেরও শেষ রক্ষা হয়নি। পরদিন কারাগারের ভেতর কমপক্ষে ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতদের একটি গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়। দুই দিনে ৫ বার গুলি করার পরও বেঁচে যান সকল ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ফারুকুল ইসলাম। তবে তার অপর দুই ভাই নাসির ও শানু শহীদ হন। কেষ্ট ডাক্তার নামে পরিচিত কৃষ্ণ দাস গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে ছিলেন। হামাগুড়ি দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তা পার হওয়ার সময় তাকে ধরে কোদালের বাট দিয়ে মাথা গুঁড়িয়ে হত্যা করা হয়। এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল পাথরঘাটার লক্ষণ দাস অ তার ছেলে অরুণ দাসকেও। অনেককে পটুয়াখালী নিয়েও হত্যা করা হয়। যাদের অনেকের নাম আজও জানা যায়নি।
একাত্তরে এ দুটি দিনে বরগুনা জেলখানায় আটককৃত ৭২ জন নিরীহ বাঙালিদের গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁদেরকে একই গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।
বরগুনা শহরের পৌর এলাকার শহীদ স্মৃতি সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিকে হেঁটে গেলে চোখে পড়বে লাল রঙ করা পাচিল ঘেরা জেলখানা। জেলখানার দক্ষিণ পাশে শহীদদের গণকবর। যেখানে বরগুনার মুক্তিকামী মানুষদের ’৭১ মাটি চাপা দেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে সেখানে একটা স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয়েছে।
জেলখানায় এসব ঘটনায় সাক্ষী ফাকরুল ইসলাম বরগুনা কারাগারের হত্যাকাণ্ডের কথা জানান।
বরগুনা কারাগারে ৭২ জন ও অন্য ৬ জনসহ ৭৮ জনের নাম উল্লেখ করে বরগুনা গণকবরের পাশে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।