You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.02 | চরমপত্র ২ জুন ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশে একটা কথা আছে- জাতে মাতাল, তালে ঠিক। সেনাপতি ইয়াহিয়ার এখন সেই অবস্থা। বাহ্যত তার কথাবার্তা আবােল-তাবােলের মতাে হলেও আসল কারবারে তার জ্ঞান একেবারে টনটনে। বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যখন দেখলেন যে, আওয়ামী লীগ অবিশ্বাস্য ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, তখনই তিনি দেহি পদ-পল্লব-মুদারম্ হয়ে শেখ মুজিবকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ডাকতে শুরু করলেন। ভেবেছিলেন শেখ সাহেব ক্ষমতার লােভে পাকিস্তানের ক্লিক রাজনীতির সঙ্গে আপােষ করবেন। কিন্তু যখনই সেনাপতি ইয়াহিয়া বুঝতে পারলেন যে, এ বড় শক্ত হাড্ডি, তখনই লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের ধমক দেখালেন। শুধু তাই-ই নয়, নতুন ফর্মুলার মন্ত্র দিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় পাঠালেন। সা’বে কইছে কিসের ভাই আহাদের আর সীমা নেই। ভুট্টোর চোখে মুখে কথার খই ফুটতে শুরু করলাে। তিনি দৌড়ে এসে ঢাকায় শেখের সংগে বৈঠকে মিলিত হলেন। কথার জাল বিস্তার করে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নরম করার প্রচেষ্টা করলেন। কিন্তু শেখের এক কথা ‘আমরা সবাই যখন গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে চেচাচ্ছি, তখন পার্লামেন্টের ফ্লোরেই সব কিছুর ফয়সালা হবে। ভুট্টো তার যুক্তি ঘুরিয়ে বললেন, পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ আর পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি যখন বেশি আসন পেয়েছে তখন পার্লামেন্টের বাইরে এ দুটো পার্টির মধ্যে একটা সমঝােতা হওয়া দরকার। কিন্তু শেখ ছােট্ট একটা হাসি

৪৪

দিয়ে বললেন, ‘ভুট্টো সাহেব আশা করি আমার জবাব আগেই পেয়ে গেছেন। আমি । গরিব বাঙালিদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।’ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেয়ে চিৎকার করে বললেন, “আমার পার্টি ইলেকশনে জিতেছে বিরােধী দলে বসবার। জন্য নয়-ইলেকশনে জিতেছে মন্ত্রীত্ব করবার জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করায় পাকিস্তানের পার্লামেন্ট এখন কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিম। পাকিস্তানে তার ঘােষণায় একেবারে ‘এনকোর’ ‘এনকোর’ পড়ে গেল। গাড়ােল আর । কাকে বলবাে?

ব্যাস্ এতেই কাজ হলাে। সেনাপতি ইয়াহিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুরের সাথে কোনােরকম আলাপ আলােচনা ছাড়াই পার্লামেন্টের। অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করলেন। ভাবলেন, এতেই শেখ সাহেব। নরম হবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অসহযােগ আন্দোলনের আহ্বান জানালেন। সমগ্র বাংলাদেশ। এই জননেতার প্রতি আস্থা জানালাে। শুরু হলাে সংগ্রামের নতুন পর্যায়। সেনাপতি। ইয়াহিয়া নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন। লােক চক্ষুর অন্তরালে রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক ছাউনিতে মানব সভ্যতার সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের Blue Print তৈরী হলাে।

আর ইয়াহিয়া লােক দেখাবার জন্য শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় এলেন। দিনের পর দিন ধরে শেখের সঙ্গে বৈঠক হলাে। আর রাতের অন্ধকার নেমে আসবার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল টিক্কা, জেনারেল মিঠঠা, জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে শলাপরামর্শ হলাে। বিশ্বের ইতিহাসে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা আর ভণ্ডামীর নজীর নেই। ২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়ে সেনাপতি ইয়াহিয়া চোরের মতাে করাচীতে পালিয়ে গেলেন।

২৬শে মার্চ বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া তার আসল চেহারায় বেরিয়ে এলেন। প্রায় দশদিন ধরে ঢাকায় শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপ আলােচনার পর তিনি হঠাৎ করে ঘােষণা করলেন, শেখ মুজিব হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু- এবার আর তাকে রেহাই দেয়া হবে না। তিনি সদম্ভে প্রকাশ করলেন, শেখ মুজিব তাকে পাকিস্তানকে খণ্ডবিখণ্ড করবার ফর্মুলায় প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছিলেন আর কি? ভাগ্যিস এম.এম. আহমদ কর্নেলিয়স আর ভূট্টো ঢাকায় যেয়ে হাজির হয়েছিল? সেনাপতি ইয়াহিয়া কচি খােকা আর কি! নাক টিপলে তার দুধ বেরিয়ে আসে। শেখ মুজিব সেই কচি খােকা ইয়াহিয়ার হাতে মুড়ির মােয়া দিয়ে ভুলাচ্ছিলেন। কি অদ্ভুত যুক্তি! খান সাহেব আরাে বললেন, আওয়ামী লীগাররা সব রাষ্ট্রের শত্রু। তাই আওয়ামী লীগ বেআইনী করা হলাে। তাহলে এই রাষ্ট্রের শত্রুদের সংগে। বাছাধন এতদিন কথাবার্তা বলছিলেন কেন? নাকি শেখ সাহেব তােমার সাথে গােপন আঁতাত করলেই দেশ প্রেমিক হয়ে যেতাে?

মাস খানেক যেতেই সেনাপতি ইয়াহিয়া আবার ভােল পাল্টে ফেললেন। কিন্তু তাল তার ঠিকই রয়েছে। এম.এম. আহমদ লন্ডন-ওয়াশিংটন করেই এত্তেলা পাঠলেন, যেনােতেনাে প্রকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পাঁয়তারা করতে হবে। অমনি সব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের খোঁজ পড়লাে। ইয়াহিয়ার হাতের ব্যাটনটা

৪৫

মাটিতে পড়ে গেল। ধ্যাত্তারি না! পূর্ব বাংলা থেকে তাে ১৫৯-এর মধ্যে ১৬৭টা নির্বাচিত সদস্যই আওয়ামী লীগার। হাতের কাছে যে সব বাঙালি নেতা পাচ্ছি, সব ব্যাটাই তাে হারু মিয়ার দল। সঙ্গে সঙ্গে নতুন ফরমান এল- আওয়ামী লীগারদের মধ্যে সবাই খারাপ নয়- দু’চারটা সেই জিনিস পাওয়া যেতে পারে। বহু খোঁজাখুঁজির পর আড়াইজন পাওয়া গেল। এখন উপায়?

এবার আগাশাহীর কাছ থেকে মেসেজ এল । যদি কোনােমতে বাঙালি শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনা যায়। তবে পশ্চিমা দেশ থেকে সাহায্যের ফোয়ারা আসবে। অমনি সেনাপতি ইয়াহিয়া ইয়া-ইয়া করে উঠলেন। করাচীর এক সাংবাদিক সম্মেলনে গলাটাকে একটু Base-এ এনে অক্করে কাইন্দা হালাইলেন। লজ্জার মাথা খেয়ে বাঙালি। শরণার্থীদের ফিরে আসবার আবেদন জানালেন। কিন্তু হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছে গােলাম হােসেন! কেননা করাচীর সাংবাদিক সম্মেলনে যখন তিনি এ আবেদন জানাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা সীমান্ত এলাকায় বাঙালি শরণার্থীদের উপর বেধড়ক গুলি চালাচ্ছিল। তাই খান সাহেবের এই আবেদন পাকিস্তানের বেতারকেন্দ্রগুলাে থেকে হাম্বা-হাম্বা শব্দে রব উঠালেও একজন শরণার্থী ফিরে এল না। তাই এবারে ‘ছত্রিশা মহাশক্তি জীবন রক্ষক বটিকা’ দিয়েছেন। অর্থাৎ কিনা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, অবাঙালি রাজাকার আর মুসলিম লীগের গুণ্ডা, থুক্কু ভলানিটয়ার দিয়ে অনেক ক’টা Reception Counter খুলেছেন। কি বিচিত্তির এই দেশ সেলুকাস্! বাঙালি শরণার্থীরা ইয়াহিয়া খানের প্রেমে গদগদ হয়ে দেশে ফিরে আসুক। আর কি? তারপর বুঝতেই পারছেন এদের অবস্থা। তাই বলেছিলাম, বাংলদেশে একটা কথা আছে- জাতেমাতাল তালে ঠিক- J.M.T.T. সেনাপতি ইয়াহিয়ার এখন সেই অবস্থা।