You dont have javascript enabled! Please enable it! বক্তাবলী গণহত্যা - সংগ্রামের নোটবুক

বক্তাবলী গণহত্যা

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল ধলেশ্বরীর পাড় ধরে বক্তাবলীর ২২টি গ্রাম। বক্তাবলী ও আলীরটেক দুটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে বক্তাবলী পরগনা। তখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে সরে যাওয়ার নিরাপদ পথটি ছিল এই বক্তাবলী। বক্তাবলীর পূর্বে ও দক্ষিণে ধলেশ্বরী, আর উত্তরে বুড়িগঙ্গা নদী। দুই নদীর মাঝখানে বক্তাবলীর ২২টি গ্রামের অবস্থান।

নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় ১৯৭১-এর ২৯ নভেম্বরের ঘন কুয়াশার রাতে ৩টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে পুরো বক্তাবলী। গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরীর বুকে তারা অবস্থান নেয়। সুবেহ সাদেকের সময় বক্তাবলীর চরে গানবোট ভিড়িয়ে নদীর পাড়ে নামতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। ঘন কুয়াশা যে কোনো কারণেই হোক তারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়নি। তখন মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল, কানাইনগর হাইস্কুলসহ বক্তাবলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। নদীর পাড়ে অবস্থিত ডিক্রিরচর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়ে যায় এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কুয়াশা একটু কাটলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রথমে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাকিস্তানিরা। সকাল প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রায় দুই ঘন্টার প্রতিরোধ যুদ্ধে পাঁচ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহতও হয় বেশ কজন পাকসেনা। ৫টি লাশ ও আহত দুজনকে কাধে নিয়ে পিছু হটে পাকিস্তানি সেনারা। এই প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মুন্সিগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে সরে যেতে পারে। এরপর পাকিস্তানি সেনা বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। পাক হানাদারদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে পিছু হটে মুক্তিবাহিনী। আর তখনই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব। তারা ডিক্রিরচর নদীর পাড়ে ৪০ জন গ্রামবাসীকে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে হত্যা করে। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়েরপাড়ার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া দলবদ্ধ গ্রামবাসীদের আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করে। রাজাপুরের হলুদ সরিষা ক্ষেতে পড়ে থাকে লাশের পর লাশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদুল্লাহ, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র আর সাধারণ কৃষককে হত্যা করে তারা। বক্তাবলীতে ১৩৯ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামই গান পাউডার দিয়ে বিকেলের মধ্যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওরা। অনেককে গুলি করে হত্যার পর ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয় হানাদার বাহিনী।

আজ চল্লিশ বছর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্রদের তালিকায় যেমন এ বক্তাবলীর শহীদদের নাম নেই, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের শহীদদের তালিকাতেও এই ১৩৯ জনের একজনেরও নাম নেই। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ২২টি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই আশ্রয় পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। এ গ্রামগুলোর ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক প্রত্যেকেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। (তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেন লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক রফিউর রাব্বি)