You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.10 | কর্ণেল ওসমানীর ভাষণ - সংগ্রামের নোটবুক

কর্ণেল ওসমানীর ভাষণ

…জঘন্য গণহত্যা এবং বাংলাদেশের মানুষের সার্বভৌম অধিকার লঙ্নের বিরুদ্ধে সেসব দেশের জনমত জাগ্রত করে তুলুন। আপনারা সেখানে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের জন্য অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য সংগ্রহ করেছেন।  আপনাদের কাছে আমার আবেদন আরও অধিক অর্থ সংগ্রহের জন্য ব্যাপক চেষ্টা করুন। কিন্তু একটি অনুরােধ যে, আমাদের ঘােষিত উপদেশের বাহিরে সংগৃহিত অর্থ ব্যয় করবেন না। আপনাদের কাছে আমার আরও অনুরােধ, আপনারা মুক্তি যুদ্ধের সমর্থনে সঙ্কল্পে অটুট থাকুন এইবং ইস্পাত কঠোর ঐক্য বজায় রাখুন। যদি আপনারা তা করতে পারেন, তা হলে প্রয়ােজনীয় সময়াপেক্ষাও অল্প সময়ের মধ্যে আমরা জয় লাভ করব।

বিজয়ের জন্য আমাদের ৩টি জিনিষের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। (ক) বিশ্বাস

আল্লাহর বিধানের উপর বিশ্বাস রাখুন। সত্য ও ন্যায়ের জয় চিরকালই হয়েছে। আর বিশ্বাস রাখুন নিজ বাহুবলের উপর। এমন কোন বাধা বিঘ্ন নেই, যা আমাদের বিজয়ের পথে অন্তরায় হতে পারে। সকল বাধাবিঘ্নকে চূর্ণ করে জয় আমরা অর্জন করবােই।

(খ) দৃঢ় সঙ্কল্প

আপনাদের দৃঢ় সঙ্কল্প থাকতে হবে। যে কোন মূল্যেই শত্রুকে ধ্বংস করে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সার্বভৌমত্ব ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে।

(গ) নিঃস্বার্থ এবং প্রাণপন চেষ্টা

আমাদিগকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে রাতদিন প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে হবে। সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করতে হবে যাতে শত্রু এক মুহূর্তের জন্যও অবকাশ না পায়।

আপনাদিগকে দলমত নির্বিশেষে সকল পার্থক্য ভুলে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি নিতে হবে, শত্রুর উপর আঘাত হানতে হবে এবং শত্রুকে ধ্বংস করতে হবে। শেষ শত্রুটি ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না। মনে রাখবেন, শত্রু আমাদের মধ্যে অনৈক্য গৃহবিবাদ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে। তারা আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরােধ এবং আমাদের মধ্যে অথবা আমাদেরও মিত্র রাষ্ট্রের সাথে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা করবে। এসব ব্যাপারে আমাদিগকে সতর্ক থাকতে হবে। | ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারত তাদের যে উদারভাবে গ্রহন করেছেন এবং তাদের চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও যেভাবে শরনার্থীদের সেবা যত্ন করে চলেছেন, তার জন্য আমরা ভারতের সরকার এবং জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের প্রাণ প্রিয় এবং প্রেরণা সৃষ্টিকারী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বিনাশর্তে মুক্তি, সাড়ে ৭ কোটি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার সৈন্য অপসারণ ছাড়া কোন মীমাংসাই হতে পারে না। উপসংহারে আমি বাংলার মহান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলব উষার দুয়ারে হানি আঘাত, আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত, নব-নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহা শ্মশান, আমরা আনিব নূতন প্রাণ। বাহুতে নবীন বল। “আমি যদি তােমাদের আদেশ দিতে নাও পারি তােমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো, শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে’ …. ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষকে এই আদেশ দিয়েছিলেন।  

তাঁর এই দূরদৃষ্টি পূর্ণ বাক্যটির মধ্যে তিনটি কথা স্পষ্ট। প্রথম কথাটি তার জীবন সম্পর্কিত আশংকা দ্বিতীয়টি পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের শত্রু এই উপলব্ধি ও তৃতীয়টি আমাদের সম্মুখ যুদ্ধে অন্ত্রের সম্ভাব্য অভাব। প্রকৃত প্রস্তাবে সেদিনেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। ২৬শে মার্চের পরবর্তীকালীন স্বাধীনতা ঘােষণা অবশ্য একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাপার-যা শে মার্চেরই পরিণিত। কিন্তু ৭ই মার্চেই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ঘােষিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে। কতােবড়াে দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন এই কথাটি থেকে আমরা তা উপলব্ধি করছি। তার আদেশ দেবার জন্য আমাদের মধ্যে থাকতে না পারার আশংকা তিনি এর আগেও পল্টনের। ময়দানে ৩রা মার্চের ভাষণে বলেছিলেন। তার জীবনের ওপর আঘাত হানার জন্য কয়েকবার চেষ্টাও। হয়েছিল। যাহােক তার এই বক্তব্যের মধ্যে যে কথাটি আমাদের আজকে সবচেয়ে বেশী ভাবিত করছে তা হলাে তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করার আদেশের মধ্যে। ৭ই মার্চে আমাদের চোখের সামনে তিনি যে অনাগত সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের ইংগিত দিয়েছিলেন-২৬শে মার্চ থেকেই সেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু। তিনি আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত-পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। আমরা জীবনমরণ যুদ্ধে লিপ্ত এবং আমাদের কাছে যা আছে তাই নিয়েই আমরা শত্রুর মােকাবিলা করছি। আজ ছ’মাস ধরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে আমাদের স্বাধীনতার লড়াই চলছেই।

যারা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় সন্দেহ করেন এই বক্তব্যটুকুর মধ্যেই তারা নিশ্চয়ই তাদের ভুল বুঝতে পারবেন। শসের মোকাবিলা করার আদেশ দিয়ে ৭ তারিখে স্বাধীনতা ঘােষণা করেও , এই গণহত্যাকে এড়ানাের জন্যে ইয়াহিয়ার সংগে আলােচনার বসেছিলেন। কেননা পাকিস্তানের সংগে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করতে গেলে শুধু জনসমর্থন ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষই যে শেষ কথা নয় তিনি তা জানতেন। ‘তােমাদের যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করাে”,….. এই কতাটির মধ্যেই তাই অনেক কিছু না থাকার বেদনা ও আক্ষেপ প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। আমাদের সম্ভাব্য অস্ত্রাডাব তিনি। উপলব্ধি করেছিলেন। এই কথাটি উচ্চারণ করার সময় নিশ্চয়ই তার চোখের সামনে উত্তেজিত নিরস্ত্র লক্ষ লক্ষ বাঙালীর ছবি ভেসে উঠেছিল-যারা জীবনের ভয় করেন। মৃত্যুই যাদের একমাত্র হাতিয়ার। তবুও তিনি উচ্চারণ করেছিলেন-কেননা এই উচ্চারণ অবশ্যম্ভাবী ছিল। স্বাধীনতা হয়ে উঠেছিলাে অনিবার্য।

আমরা অনেক মৃত্যু অনেক আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সামনে নিয়ে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি তার সামনে তার সেই উচ্চারণ আজ আরাে স্পষ্ট আরও তীব্র হয়ে কাজ করছে। আমাদের কিছুই নেই, শূন্য হাতেই আমাদের যাত্রা করতে হবে কিন্তু যে প্রেম রূপান্তরিত হয় দেশপ্রেমে সেই স্বাধীনতার স্পৃহাই আমাদের এক একটি মারণাস্ত্রে এক একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে রুপান্তরিত হয়েছে। আমাদের সংগে যুক্ত হয়েছেন বেঙ্গল রেজিমেন্টর বাঙালী বীর যােদ্ধারা, যুক্ত হয়েছেন ইপিআর বাহিনী, পুলিশ ও ছাত্র কৃষক-শ্রমিক জনতার নতুন সৈনিক। আগুন দিয়ে আগুন জ্বালানাের মতােই এ যেন অস্ত্র দিয়ে অস্ত্র কেড়ে নেবার পালা শুরু হয়েছে ২৫শে মার্চের রাত থেকে। আমরা শত্রুর হাত থেকে আমাদের পয়সার কেনা অস্ত্র কেড়ে নিয়েছি। আমাদের প্রাপ্য অস্ত্র আমাদের হাতে এসেছে। শত্রুর অস্ত্রই আমাদের অস্ত্র।

বিশ্ববাসী মুগ্ধ হয়ে অবাক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছেন শান্ত কোমল বাংলা দেশের মাটী থেকে এ কি রকম উজ্জীবন, একি ভীষণ পরাক্রম নিয়ে ওরা আজ যুদ্ধে লিপ্ত।  পৃথিবীর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের সহানুভূতি আমরা লাভ করছি। ভারত সবচাইতে বন্ধুর মতাে ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের আদেশ মতাে জীবন দিয়ে জীবনযাত্রার কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের মুক্তি ফৌজ মুক্তি বাহিনতে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের অভাবে আমরা আমাদের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের শক্তিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারছি না। যে অনিবার্য অভাবের কথা ভেবে শেখ মুজিব ৭ই মার্চে  আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘােষণা করেন নি আজ এর দীর্ঘ ৭ মাস পরেও আমরা সেই অভাব থেকে উত্তরণ পাইনি। আমাদের প্রতিটি অস্ত্র শত্রুর হাত থেকে কেড়ে নেয়া-আমাদেরই বুকের রক্তে রক্তাক্ত। এই অস্ত্র কেড়ে নিয়েই, জীবনের মূল্যে অস্ত্র কেনার মতােই দীর্ঘযুদ্ধের ভয়ঙ্কর খেলা শেষে আমাদের স্বাধীনতা তবু আসবেই। কিন্তু এই স্বাধীনতা যুদ্ধে কোন রাষ্ট্রই কি রাজনৈতিক লাভক্ষতির বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে এগিয়ে আসবে না?

দাবানাল ॥১; ৩

১০ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯