You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.15 | রণাঙ্গনের খবর - সংগ্রামের নোটবুক

রণাঙ্গনের খবর

(রণবার্তা পরিবেশক) বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় সকল রনাঙ্গণে বীর মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ প্রচণ্ডতর হইয়া উঠিতেছে। মুক্তিযােদ্ধারা দখলীকৃত এলাকার সর্বত্র বিপুল সংখ্যায় ছড়াইয়া পড়িয়া শত্রুসেনাদের গতি প্রতিরােধ করিয়া ইহাদের ব্যস্ত রাখিয়া চলিয়াছেন। সর্বত্রই বঙ্গশার্দুল মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রহিয়াছে। ঢাকা হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, বাংলাদশের দখলীকৃত এলাকায় ইসলামাবাদের অসুর বাহিনীর সুরক্ষিত সদর দফতর বলিয়া কথিত খােদ ঢাকা নগরী সহ উহার চার পার্শ্বে এবং ঢাকা জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ চলিতেছে। মুক্তিযােদ্ধারা ঢাকা হইতে শত্রুসেনা বাহির হওয়ার সবকয়টি গুরুত্ব পূর্ণ রেল, সড়ক এবং জলপথে ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধি করিয়াছেন। ঢাকানগরীর সহিত স্থলপথে রেল ও সড়ক যােগাযােগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়া দুঃসাহসিক মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুসেনাদের অবাধ গতিবিধি এবং রসদ সরবরাহ ব্যাহত করিয়া চলিয়াছেন। ঢাকা নগরীতেও খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষের মাধ্যমে। তাঁহারা খানসেনাদের ব্যস্ত রাখিয়া নাস্তানাবুদ করিতেছেন।  মুক্তিযােদ্ধারা কার্যতঃ ক্যান্টমেন্টে তথা ঢাকা নগরীকে চারদিক হইতে অবরােধ করিয়া ফেলিয়াছেন। ঢাকার চারপাশের এলাকা এবং জেলার সর্বত্র ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া পড়িয়া বিভিন্ন রণক্ষেত্র খুলিয়া হানাদার শত্রুসেনাদর বিপর্যস্ত করিতেছেন। জেলার অভ্যন্তর ভাগেও মুক্তিযােদ্ধারা খণ্ড যুদ্ধে খানসেনাদের খতম হয়রানী করিতেছেন বলিয়া খবর পাওয়া যাইতেছে।  ঢাকা হইতে যে দিক দিয়াই খানসেনারা বাহির হয় সেই দিকেই মুক্তিযােদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান প্রচণ্ড প্রতিরােধের মুখে বাধা প্রাপ্ত হয়। দখলীকৃত এলাকার রাজধানী ঢাকা শহর জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই মুক্তিযােদ্ধাদের সহিত খান সেনাদের খণ্ড যুদ্ধ হইতেছে। এইসব খণ্ড যুদ্ধে ইতিমধ্যেই বহু সংখ্যক হানাদার সেনা হতাহত হইয়াছে।

ঢাকা হইতে আমাদের প্রতিনিধি জানান, সেদিন খােদ ঢাকা নগরীতেই প্রকাশ্য দিবালােকে চলন্ত মােটর হইতে মেসিনগানের সাহায্যে গুলি করিয়া মুক্তিযােদ্ধারা ৫ জন খান সেনা খতম করেন। মুক্তিযােদ্ধারা একটি প্রাইভেট ট্যাক্সী যােগে শহরের কোন একটি এলাকায় ঘুরাফেরার সময় টহল রত খান সেনারা মুক্তিফৌজ সন্দেহে তাঁহাদের অনুসরণ করে। খান সেনারা জীপ হইতে গর্জন করিয়া মােটরটিকে থামিয়ে নির্দেশ দেওয়া মাত্রই তাহাদের সম্মুখের ট্যাক্সীর পিছনের কাচ ভাঙ্গিয়া মুক্তিযােদ্ধাদের মেসিনগান গর্জিয়া উঠে। হতভম্ব খান সেনাদের হাতের মেসীনগানের ট্রগারে আঙ্গুল স্পর্শ লাগিবার পূর্বেই তাহাদের রক্তাক্ত দেহ লুটাইয়া পড়ে ঢাকার পীচ ঢালা কালাে রাস্তায়। সম্মুখের গাড়িটি ততক্ষণে নিরুদ্দেশ হইয়া যায়।

এইত সেইদিন, খান সেনাদের কঠোর প্রহরাধীনে একখানি ট্রেন ঢাকা হইতে ময়মনসিংহ যাইতে ছিল। কিন্তু ঢাকা নগরী হইতে প্রায় ৩০ মাইল উত্তরে চাকা জেলার সীমান্ত কাওরাইদ অতিক্রম করার পূর্বেই ট্রেনের ইঞ্জিনটি একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে খান খান হইয়া যায়। ট্রেনের বগী কয়টি উল্টাইয়া পড়ে। ব্যাপার বুঝিবার পূর্বেই খানসেনাদের বুক ঝাঝরা হইয়া যায় মেসিনগান আর রাইফেলের গুলিতে। | সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে খানসেনারা লঞ্চযােগে যাইতেছিল নওয়াবগঞ্জ ও দোহার থানা দখল করার জন্য। ঢাকা হইতে বুড়িগঙ্গা দিয়া বাহির হইয়া ইছামতিকুলের বান্দুরায় লঞ্চটি পৌছলে মুক্তিযােদ্ধারা ইহাদের উপর প্রচণ্ড গােলাগুলি বর্ষণ করেন। ফলে ৩৪ জন খানসেনা মারা যায়। অন্যান্যদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। লঞ্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

এইদিনই নওয়াবগঞ্জের নিকট মুক্তিযােদ্ধারা খানসেনাদের অপর একটি লঞ্চের উপর আক্রমণ চালাইয়া প্রায় ২৫ জন শত্রুসেনা খতম করেন। ইহাদের লঞ্চটি ও ক্ষতি সাধন করা হয়। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার অন্যান্য রণাঙ্গন হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় মুক্তিযােদ্ধারা বীরবিক্রমে হানাদার সেনাদের মােকাবিলা করিয়া চলিয়াছেন। সর্বত্রই তাহারা শত্রুসেনাদের ব্যস্ত রাখিয়া নাজেহাল এবং হয়রানী করিতেছেন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার অন্তর্গত কাকডাঙ্গা, মাদ্রা এবং বােয়ালিয়া এলাকায় প্রায় এক ব্রিগেড শত্রুসেনাদের একটানা তিনদিনব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত রাখেন। | এই খণ্ডে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রায় ৪ শত খানসেনা খতম হয় বলিয়া প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসীর নিকট হইতে জানা যায়। মুক্তিযােদ্ধারা এই রণাঙ্গন হইতে ৬ জন শত্রুসেনা গ্রেফতার করেন। ইহা ছাড়া প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করেন। প্রায় ৪ শত খানসেনা নিহত হওয়ার পর অন্যান্য খানসেনারা পলায়ন করে।

বাংলার বাণী ৬ সংখ্যা

১৫ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯