You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.01 | রণাঙ্গন থেকে লিখছি - সংগ্রামের নোটবুক

রণাঙ্গন থেকে লিখছি

যতই কাছে এগুচ্ছি ততই গুলির শব্দ আর কামানের শব্দগুলাে স্পষ্ট হচ্ছে। এগুচ্ছি। একটা অজানা আশংকায় বুকের মধ্যে তােল পার করছে। রনাঙ্গনের এতাে কাছে কখনও আসার সুযােগ হয়নি। মাটি কাঁপিয়ে কামানের গােলাবর্ষণ। রাইফেলের গুলীর শব্দকে মনে হচ্ছে ছিটে ফোটা। ভীষণ শব্দে অবিরাম ভাবে বর্ষিত হচ্ছে মেশিনগান আর মর্টারের গুলি উভয় পক্ষ থেকেই। সে শব্দে কুমিল্লার আমড়াতলীর সব প্রাণী পালিয়েছে দূরে বহুদূরে। নিরাপদের আশায়। একজন অতি সাধারণ ছেলে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাে। আর এগুতে নিষেধ করলাে। তবুও হেসে তার হাত ধরে এগুলাম আরও একটু । কিন্তু কঠিন হয়ে দাড়িয়ে পরলাে ছেলেটি। না আর এগুনাে নিরাপদ নয়।  দাড়িয়ে পড়েছি। মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশেরই সমর অবস্থান চোখে পড়ছে। মাটির ওপর উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে গুলি চালাচ্ছে। কেউ কেউ মাটি খুড়ে খােলা গর্তের মধ্যে বসে বসেও চালাচ্ছে নিজের হাতের অস্ত্র। কত নিপুন হাতে সে অস্ত্রের চালনা হচ্ছে। বাংলার মানুষকে বলা হয়েছিলাে কাপুরুষ। এরা অস্ত্র চালাতে জানেনা। কিন্তু আমার সামনে মাতৃভূমির শত্রু মুক্তির অভিযানে কত নিপুন ভাবে চালাচ্ছে অস্ত্র । 

বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতম অস্ত্র যেন প্রাণ পেয়েছে মুক্তি বাহিনীর বীর যােদ্ধাদের হাতে। এক একটা শত্ৰু কামানের গােলা এসে পড়ছে লক্ষ্যহীন ভাবে এদিকে ওদিকে বিক্ষিপ্ত ভাবে। মাটিটা কেঁপে উঠছে ভয়ংকর ভাবে। একটু ভূ-কম্পন হচ্ছে যেন। আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলাে ছেলেটি। এমনি অবস্থায় দাড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। মাটিতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি করছে কামানের গােলা উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে মাটি । আবার গুড়াে গুড়াে হয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে মেশিনগানে নতুন গুলি ভর্তি করে নিচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট এখান থেকে।  পাক সেনাদের যুদ্ধের সাধ বুঝি মিটে গেল। গােলা বর্ষণ মেশিনগানের গুলি ছােড়া, রাইফেলের বিক্ষিপ্ত গুলির সাই সাই সব শব্দ বন্ধ হয়ে গেল কেন? শত্রুর আকস্মিক অস্ত্র সম্বরণে মুক্তিবাহিনী একটু চঞ্চল হলাে। শত্ৰু কি নতুন দিক থেকে আক্রমণ শুরু কবে নাকি? অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা। হাতে উদ্যত রাইফেল আর মেশিনগান। যে কোন আক্রমণ প্রতিরােধের জন্য প্রস্তুত।

হঠাৎ কয়েকটা গাড়ী ষ্টার্ট নিয়ে দ্রুত পলায়নের শব্দ। পালাচ্ছে পাক সেনারা। তাইতাে জীপ, লরী করে পাক হানাদার বাহিনী সত্যিই পালাচ্ছে। যুদ্ধের সাধ মিটে গেলাে। শেষের ট্রাকটা ভর্তি রক্তাক্ত বেশ কিছু পাক সেনার দেহ দেখতে পাচ্ছি। ওগুলাে কি মৃতদেহ? তা হলে তাে অন্ততঃ কুড়িজন পাকসেনা মরেছে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমনে নিহত হয়েছে হিংস্র পশুর মত আচরণকারী পাকসেনারা। পরাজিত কাপুরুষের মত রণাঙ্গন থেকে পিছু টান দিলাে পাক বাহিনী। রণক্লান্ত মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। ক্লান্তির ছায়া পড়েছে কিন্তু আশ্চৰ্য দুর্জয় শপথের ঔজ্জ্বল্য তখনও অম্লান দুটো চোখে । আমাকে কাছে পেয়ে হাসলাে সাফল্যের হাসি। রণাঙ্গণ পিছনে ফেলে ফিরে চললাম ছেলেটির সঙ্গে সঙ্গে। হাত নেড়ে নেড়ে নিজের দেখা আরও অনেক রণাঙ্গণের কাহিনী বলছে ছেলেটি।

বাংলারমুখ।১: ৭-৮ !

১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯