You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.26 | রণাঙ্গন থেকে - সংগ্রামের নোটবুক

রণাঙ্গন থেকে

সাংবাদিক গত ৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনীর ৪০ জন সৈন্য ও ১০০ জন রাজাকার ময়মনসিংহ জেলার নিকলী থানার গুড়ােই গ্রামে হত্যা ও লুঠতরাজের জন্য আসিয়া চড়াও হয়। তিনটি বড় নৌকা। বােঝাই হইয়া ঐ দস্যুরা ভাের রাতেই গ্রামটি ঘিরিয়া ফেলে ও গুলি করিতে করিতে নামিয়া লুঠতরাজ শুরু করে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হইতে বীর মুক্তিবাহিনীর একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে আগাইয়া আসে এবং ছােট ছােট দলে বিভক্ত হইয়া সুবিধাজনক অবস্থান লইয়া হানাদারদের উপর আক্রমণ চালায়। লুটের লালসা আর মেয়ে ধরার নেশায় ঐ বর্বরগুলির তখন মাথার ঠিক নাই। উহারা যুদ্ধ করিবে কি? | বিভিন্ন দিক হইতে মুক্তি বাহিনীর গুলি আসিতে থাকায় শত্রুরা দিশাহারা হইয়া পড়ে। ৪ জন শত্রু সৈন্য ও ১২ জন রাজাকার খতম হওয়ার পর তাহারা গ্রাম ছাড়িয়া পালাইতে শুরু করে। গ্রামবাসীরাও তখন সড়কি বল্লম লইয়া শত্রু বাহিনীর উপর ঝাপাইয়া পড়ে এবং ৬ জন রাজাকারকে ধরিয়া ফেলে। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের মুখােমুখি সড়কি-বল্লম লইয়া দাঁড়াইয়া গ্রামবাসীরা জনবল, মনােবল ও মৃত্যুঞ্জয়ী দেশপ্রেমের জ্বলন্ত পরিচয় উপস্থিত করিয়াছে। গ্রামটির উপর শত্রুদের প্রাথমিক আক্রমণ ও পরবর্তী সংঘর্ষে ৫৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। ঢাকা ঢাকা জেলার টঙ্গী ও তেজগাঁও থানায় গেরিলা তৎপরতা জোরদার হইয়াছে। সম্প্রতি মুক্তিযােদ্ধারা গ্রেনেড চার্জ করিয়া ফয়দাবাদ গ্রামে ১১ হাজার ভােল্ট-এর একটি বিদ্যুৎস্তম্ভ উড়াইয়া দিয়াছে। দক্ষিণ খান গ্রামে গেরিলারা ৪ জন রাজাকারকে হত্যা ও বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করিয়াছে। 

সম্প্রতি টঙ্গী থানার শান্তি কমিটির এক সভায় গেরিলারা গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। ইহাতে টঙ্গী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সহ কয়েকজন দালাল মারাত্মকভাবে আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা গাছা ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সদস্য হযরত আলী ও পুবাইল ইউনিয়নের নায়েবকে খতম করিয়াছে। আরও তিনটি জাহাজ ডুবিল স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে বলা হয়, গত সপ্তাহে মুক্তি বাহিনীর বীর গেরিলা দল মঙ্গলা বন্দরে একটি মার্কিন জাহাজও একটি মালবাহী পাকিস্তানী জাহাজ ডুবাইয়া দিয়াছে। পানির নিচে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে জাহাজ দুইটি ধ্বংস ও নিমজ্জিত হয়। খুলনায় অপর একটি পাকিস্তানী জাহাজ মুক্তি যােদ্ধারা ধ্বংস করিয়াছে। উল্লেখযােগ্য যে, মাত্র কিছুদিন আগে মুক্তিবাহিনী মার্কিন ও চীনা অস্ত্রবাহী জাহাজ সহ ডজন খানেক জাহাজ বাঙলাদেশের বন্দরগুলিত ডুবাইয়া দিয়াছিল। রূপগঞ্জ থানায় এক অভিযান চালাইয়া মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ৫ জন শত্রু সৈন্য, ৭ জন রাজাকার, থানার দারােগা ও ৪ জন পুলিশকে হত্যা করিয়াছে ও প্রচুর পরিমাণ মজুত অস্ত্র ধ্বংস করিয়া দিয়াছে।

ঢাকা শহর ও আশপাশে মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাইয়া ইয়াহিয়ার জল্লাদরা ঢাকার উপকণ্ঠের গ্রামগুলির নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করিয়া উহাদের বীরত্ব প্রকাশ করিতেছে। এই গ্রামগুলিতে হানাদার পশুরা অনেকগুলি ক্যাম্প বসাইয়াছে এবং ক্যাম্প সংলগ্ন গ্রামগুলিতে নির্যাতন চালাইতেছে। সম্প্রতি ঢাকা শহর হইতে তিন মাইল দূরবর্তী নাসিরাবাদ, ত্রিমােহিনী প্রভৃতি গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্যাপক নরহত্যা, অগ্নিসংযােগ, লুণ্ঠন ও নারী নির্যাতন চালায়। নাসিরাবাদ গ্রামে এই পিশাচের দল নারী শিশু সহ শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করিয়াছে। গত ১৩ই সেপ্টেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা ঢাকা হইতে নরসিংদীগামী একটি ট্রেন পুবাইল স্টেশনের কাছে মাইনের সাহায্যে উড়াইয়া দেয়।  পরের দিন পাকিস্তানী হানাদার দস্যুরা আকাশ ও স্থলপথে এই এলাকার নিরস্ত্র মানুষের উপর আক্রমণ চালায়। হেলিকপ্টার হইতে স্টেশনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করে ও পুবাইল বাজারটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে। দখলদার বর্বর সেনারা এই স্থানে ২৫/৩০ জন লােককে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। এই এলাকার চার পাঁচটি গ্রামের লােক ঘরবাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে।  গত ১১ই সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা চাষাড়ার মধ্যবর্তী রেলওয়ে ব্রীজ মাইনের সাহায্যে উড়াইয়া দেয়।

এই ঘটনার প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য বর্বর হানাদাররা ধাপা, পিঠালিপুর ও হাজিগঞ্জ এলাকায় তিন শতাধিক গৃহ ভস্মীভূত ও ১৫০ জনের মত নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করিয়াছে। গত ১১ই সেপ্টেম্বর রায়পুরা থানার জয়নগরে গেরিলারা তিতাস গ্যাস পাইপলাইন উড়াইয়া দিয়াছে। সিলেট সম্প্রতি মুক্তিযােদ্ধারা সিলেটের চাতলাপুরে শত্রু সৈন্যদের একটি ঘাটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। কয়েক ঘণ্টা উভয় পক্ষে সংঘর্ষের পর শত্রু পক্ষ ঘাটি পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়। শমসের নগর হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় উক্ত সংঘর্ষে ১৪জন পাক সৈন্য ও ৮ জন রাজাকার খতম হইয়াছে এবং ৬ জন পাক সৈন্যকে হাসপাতালে ভর্তি করা হইয়াছে। কুমিল্লা মুক্তিযােদ্ধারা গত ১০ই সেপ্টেম্বর কুমিল্লার হাজীগঞ্জে শত্রু সৈন্যদের একটি দলের উপর হঠাৎ দুই দিক  হইতে আক্রমণ করিয়া কমপক্ষে ৩০ জনকে খতম করে। হানাদাররা নিহতদের মৃতদেহ ফেলিয়াই পালাইয়া যায়। গেরিলারা শত্রুর ফেলিয়া যাওয়া বহু অস্ত্র-শস্ত্র দখল করিয়া নেয়। চট্টগ্রাম। গত এক পক্ষ কালের মধ্যে চট্টগ্রামে বহু রাজাকার ও দালাল খতম করা হইয়াছে। মুক্তিসেনারা। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার জিরি মাদ্রাসা ভবনে রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণ করিয়া ১২ জন। রাজাকারকে হত্যা করে ও ১৭টি রাইফেল ও প্রচুর গুলি হস্তগত করে। এই সময় চট্টগ্রামে যে-সব দালালকে খতম করা হইয়াছে তাহারা হইতেছে আনােয়ারা থানার। উসখাইল গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য মুসলিম লীগের আব্দুল হাকিম ও খাসকাসা গ্রামের ফজইল্লা নামে এক কুখ্যাত দালাল। ইহাছাড়া গত ১০ই সেপ্টেম্বর মালিয়াপাড়া গ্রামে মুক্তিবাহিনী ১১ জন মুসলিম লীগের দালালকে খতম করিয়াছে।

মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ১২

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯