রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ভারত সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে শরণার্থী শিবিরে রাষ্ট্রপতি ভি, ভি, গিরি
(স্টাফ রিপাের্টার)
কলকাতা, ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ভি, ভি, গিরি আজ নদীয়া জেলার কল্যাণীতে বাঙলাদেশ শরণার্থীদের জানান যে, তারা যাতে যথাশীঘ্র সম্মান ও নিরাপত্তা সহকারে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন সে উদ্দেশ্যে একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ভারত সরকার সর্বতােভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। রাষ্ট্রপতি পরে কলকাতায় নাগরিক পরিষদের সদস্যদের বৈঠকে বলেন, বিশ্ব জনমতের চাপে পাকিস্তানী শাসকবর্গ বাঙলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা মীমাংসায় আসতে বাধ্য হবেন বলে তিনি মনে করেন। এই বৈঠকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উঠলে তিনি আরাে বলেন যে, মূল্যবৃদ্ধি রােধের জন্য সরকার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন, কিন্তু ক্রেতাদের মূল্যবৃদ্ধি রােধে তৎপর হতে হবে। রাষ্ট্রপতি আগামীকাল উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন। আজ সকালে রাষ্ট্রপতি শ্রীগিরি বিমানে নয়াদিল্লী থেকে দমদম বিমানবন্দরে পৌছুলে রাজ্যপাল শ্রী এ এল ডায়াস, মুখ্যসচিব শ্ৰী এন সি সি সেনগুপ্ত, মেয়র শ্রী শ্যামসুন্দর গুপ্ত, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শ্রী আবদুস সাত্তার, প্রদেশ কংগ্রেস কোষাধ্যক্ষ শ্রীতরুণকান্তি ঘােষ এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এর অন্যান্য উচ্চ পদস্থ অফিসাররা তাকে অভ্যর্থনা জানান। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর ছেলে শ্রীশঙ্কর গিরি এবং বাঙলাদেশ প্রতিরােধ সহায়ক সমিতির চেয়ারম্যান শ্রীমতি পূজা নাইডুও এসেছেন। দমদম বিমান বন্দর থেকে রাষ্ট্রপতি শ্রীগিরি রাজ্যপালের সঙ্গে একটি হেলিকপ্টারে কল্যাণী যান। শ্রীমতি নাইডু আলাদা একটি হেলিকপ্টারে কল্যাণী অভিমুখে যাত্রা করেন। রাষ্ট্রপতি কল্যাণীর দু’টি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। শরণার্থী শিবিরে রাষ্ট্রপতি পৌঁছুলে হাজার হাজার শরণার্থী রাষ্ট্রপতি শ্রী গিরির ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক শেখ মুজিব এর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে শ্রী গিরিকে সম্বর্ধনা জানান। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে যথাশীঘ্র সম্ভব বাঙলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার উপরে জোর দিয়ে বলেন, “আমরা চাই পাকিস্তানী শাসক ও বাঙলাদেশের মধ্যে একটা রাজনৈতিক মীমাংসা হােক।” এবং “সে মীমাংসা অবশ্যই বাঙলাদেশের জনগণের পক্ষে সন্তোষজনক মীমাংসা হতে হবে।” এই মীমাংসা যে বাঙলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও জননেতাদের সঙ্গে করতে হবে, কোনও ক্রীড়নক দালালের সঙ্গে নয়, পাক সরকারের সেই বােধােদয় এখনাে হয় নি। তিনি শুধু এই আশাই করতে পারেন যে, পাকিস্তানের শাসকরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই এটা উপলব্ধি করবেন”। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি পশ্চিমের যে ৬টি দেশ সফর করে এসেছেন, তার উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, এর ফলে ঐসব দেশের মানুষ ও রাষ্ট্রনায়করা বাঙলাদেশেরও মানুষের সংগ্রামের ন্যাব্যতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন এবং তিনি আশা করেন যে, এর ফলে পাকিস্তান বুঝবে যে, বিশ্ব জনমত বাঙলাদেশের সঙ্গে এবং বিশ্ব জনমতের চাপ পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করবে বাঙলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ও জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনায় বসতে। তিনি শরণার্থীদের আগামী কয়েক সপ্তাহে কী ঘটে সেজন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার আবেদন জানান। ইউএনআই আরাে জানাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করেন যে, বিভিন্ন ফ্রন্টে ভারত বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন, তা সত্বেও ভারতে বাঙলাদেশ শরণার্থীদের সাময়িক অবস্থানকালে তাদের ক্লেশ না করার জন্য ভারত যে কোনও স্বার্থত্যাগ প্রস্তুত থাকবে। তিনি বলেন, “যে সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তেমনি এক সরকারের বর্বরােচিত কার্যকলাপের ফলে আপনারা যারা নিজেদের দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি জানাবার জন্য তিনি এখানে এসেছেন। তিনি সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে বর্তমান ক্লেশের মােকাবিলা করার জন্য এবং ভারতের অসুবিধাসমূহ উপলব্ধি করে শিবির পরিচালনাকারী অফিসারদের সঙ্গে সহযােগিতা করার জন্য শরণার্থীদের প্রতি আবেদন জানান। অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেভাবে শরণার্থীদের আশ্রয়দানের ব্যবস্থা করেছেন সে জন্য তিনি রাজ্য সরকার ও পশ্চিমবঙ্গবাসীকে ধন্যবাদ জানান। শরণার্থীরা তাদের প্রীতির নিদর্শন হিসাবে রাষ্ট্রপতিকে হাতে তৈরি বেতের ঝু ড়, মাটির পাত্র ও আরাে কয়েকটি জিনিস উপহার দেন। শ্রী গিরি কল্যাণীতে শরণার্থীদের জন্য স্থাপিত হাসপাতাল পরিদর্শন ও রােগীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর করেন। রাষ্ট্রপতি সবশেষে ঘােষণা করেন, বাঙলাদেশের মানুষ ন্যায়ের জন্য লড়ছে। তিনি নিশ্চিত, শেষ পর্যন্ত তারা বিজয়ী হবেন। রাজভবনে আজ সন্ধ্যায় রাজভবনে পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক পরিষদের কর্ম সমিতির বৈঠকে রাজ্যপাল বাঙলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার কথা পুনঘােষণা করেন এবং শরণার্থীদের ত্রাণ ব্যবস্থা সংগঠিত করায় সরকারী প্রশাসনের প্রশংসা করেন। বাঙলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে রক্ষা করা ও আশ্রয় দেবার প্রচণ্ড বােঝা বহন করার জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণকে অভিনন্দন জানান। জানা গেল, বৈঠকে উপস্থিত সদস্যরা সকলেই বাঙলাদেশে প্রশ্নে তাদের ঐকমত্য ঘােষণা করেন। কমিউনিস্ট নেতা শ্রীবিশ্বনাথ মুখােপাধ্যায় সেই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং সরকারের ঘােষিত নীতি লঙ্গন করে কৃষকদের বিরুদ্ধে জোতদারদের আক্রমণ সংগঠিত করা ও তাতে স্থানীয় পুলিশের সহযােগিতার ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি রােধের জন্য এ পর্যন্ত অবলম্বিত ব্যবস্থাবলী আদৌ যথেষ্ট নয়। ভারত সরকারের উচিত এ ব্যাপারে দ্রুত গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শ্রী আবদুস সত্তার স্পীকার শ্রী অপূর্ব লাল মজুমদার প্রমুখ সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে বন্যায় দুর্গত স্থানীয় মানুষদের রিলিফ দেওয়ার সরকারী কাপণ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং এর ফলে স্থানীয় লােক ও শরণার্থীদের মধ্যে একটা তিক্ততা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে বলে তারা জানান। সি পি এম নেতা শ্রীজ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গে কেন নির্বাচন হবে না সেই প্রশ্ন তােলেন। একাধিক সদস্য অন্যান্য রাজ্যে শরণার্থীদের ছড়িয়ে দিয়ে পশ্চিম বঙ্গের উপর থেকে লাঘব করার কথা বলেন। মেয়র অবিলম্বে বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপতি জানান যে অন্যান্য রাজ্য যাতে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে সে জন্য তিনি মুখ্যমন্ত্রীদের বলবেন। বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নটিও যথােচিত গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি বলেন যে, মূল্যবৃদ্ধিরােধ করার জন্য অবশ্যই সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়ে এর কোন সমাধান হবে না। তিনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরােধে জনসাধারণের তৎপর হওয়া দরকার বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য অবশ্যই সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সূত্র: কালান্তর, ১৮.১১.১৯৭১