মুক্তিসংগ্রাম নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করিতেছে
(নিজস্ব প্রতিনিধি) নরখাদক টিক্কা খার জায়গায় একটি অসামরিক’ দালালকে গভর্নর করিয়া ইয়াহিয়া খাঁ বাঙলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করিতে পারে নাই। বরং জল্লাদ টিক্কার বিদায় বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের সংকল্পকে দৃঢ়তর করিয়াছে। | শ্রীহট্ট, ঢাকা, ময়মনসিং, চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়িয়া গ্রামের কৃষক, কারখানার মজুর, স্কুলকলেজের ছাত্র পাক সেনাদের প্রাথমিক আক্রমণের ধাক্কা সামলাইয়া এখন ক্রমশঃ সংগঠিতভাবে পালটা আঘাত হানিতে শুরু করিয়াছে ; বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম আজ এক নতুন স্তরে প্রবেশ করিতেছে। প্রাথমিক বিপর্যয়, পুনর্গঠন হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমণের মুখে গােড়ার দিকে নিরস্ত্র বাঙালী লাখে লাখে প্রাণ দিয়াছে, অসংগঠিতভাবে অপূর্ব বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধের মধ্য দিয়া রক্তাক্ষরে মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠা কয়টি লিখিয়াছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে হামলাকারীদের প্রতিহত করিতে পারে নাই। সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত শত্রু বাহিনীর জল-স্থল-আকাশ-পথে সম্মিলিত আক্রমণের মুখে প্রায় নিরস্ত্র মুক্তি সেনাদের পিছু হটিতে হইয়াছে। সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিং এর যে সব এলাকার কথা আমি বলিতেছি, সেখানেও ইহার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। কিন্তু সে ছিল সংগ্রামের সবে শুরু। সাত দিনের মধ্যে মুক্তি সেনাদের তবাহ করিয়া লড়াই ফতে করিবার যে-উন্মত্ত খােয়াব ইয়াহিয়া-টিক্কা খা দেখিয়া ছিল, তাহা আজ তাহাদের কাছে দুঃস্বপ্নে পরিণত হইয়াছে।
মুক্তি সেনারা প্রাথমিক বিপর্যয়ের পর নিজেদের পুনর্গঠিত করিয়া সামরিক শিক্ষায় নিজেদের আরাে শিক্ষিত করিয়া বিভিন্ন জায়গায় শত্রু সেনাদের উপরে অতর্কিত আক্রমণ চালাইয়া তাহাদের বিপর্যস্ত ও নাস্তানাবুদ করিয়া তুলিয়াছে। সিলেট জেলার কমপক্ষ পাঁচটি থানা, ঢাকার চাটি থানা এবং ময়মনসিংহের ৪টি থানা আজ কার্যত পাক-ফৌজ-মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হইয়াছে। আওয়ামি লীগ ন্যাপ (ওয়ালি-মুজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা এখানে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া বৃহত্তর সংগ্রামের প্রস্তুতি করিতেছেন। নব পর্যায়ে বাঙলাদেশের সংগ্রামী ঐক্যের সূচনা দেখা যাইতেছে । এই ঘটনা ঘটিতেছে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামেও। নবপর্যায়ে ঐক্যের প্রয়ােজন আরও বেশি। কম্যান্ডাে অভিযানের এই সাফল্যের ফলে মুক্তি সংগ্রামের ভিত্তি আজ প্রসারিত হইয়া মুক্তি সংগ্রামকে নূতনতর পর্যায়ে কমান্ডাে অভিযান হইতে গেরিলা যুদ্ধের পর্যায়ে উন্নীত হইতেছে। এই সময়ে শুধু নিচের তলায় নয়, উপর তলায়, যে স্থান হইতে সামগ্রিক মুক্তি সংগ্রামের রণনীতি ও কৌশল পরিচালিত হইতেছে সেই স্থানে, সমস্ত সংগ্রামী শক্তির সুসমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম প্রয়ােজন। মুক্তিসংগ্রামী ও স্থানীয় মানুষের মুক্ত অভিযানে গত দেড় মাসের মধ্যে ৫টি থানায় শতাধিক পাকসেনা নিহত হইয়াছে এবং শত্রুদের অস্ত্র শস্ত্র মুক্তিসেনাদের হস্তগত হইয়াছে। যেমন রায়পুরা থানায় বেলাব-তে ৩৫ জন ও নীলখ্যায় ৩ জন, মনােহরদি থানার রামপুরে ৮৭ জন, কাপাসিয়া থানার
টোকে ৮ জন এবং শিবপুর থানায় ১৪ জন পাকসেনা স্থানীয় গণবাহিনীর হাতে নিহত হইয়াছে। একদিকে শহর গ্রামের মানুষ মুক্তি সেনাদের আশ্রয় দিয়া, শত্রুদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে খবরাখবর দিয়া শত্রুর উপরে মােক্ষম আঘাত হানিতে সাহায্য করিতেছে, অন্যদিকে প্রতিটি সক্ষম মানুষ নিয়মিত সামরিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হইতেছে। একটি শিবিরে বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় শত্রুর নজরের বাহিরে এই সব সংগ্রামীদের শিক্ষা শিবির গড়িয়া উঠিতেছে। এই ধরনের একটি সামরিক শিবিরে গিয়াছিলাম। সেখানে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ছাত্র, শিক্ষক হইতে শুরু করিয়া গ্রামের কৃষক, কারখানার শ্রমিক, কিশাের হইতে মধ্যবয়স্ক সংগ্রামীরা দক্ষতর, কঠোরতর লড়াইয়ের শিক্ষা গ্রহণ করিতেছেন।
পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর বর্বর হামলা, হত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলার দরুন সােনার বাংলায় আজ দুর্ভিক্ষের কালাে ছায়া নামিয়া আসিতেছে। তাই এই সব মুক্তি সংগ্রামীদের ও সৈনিকদের উপযুক্ত খাদ্য নাই। কিন্তু ইহাদের মনে আছে দেশকে মুক্ত করার সংকল্পের অনির্বাণ শিখা। সেই আগুনের আলােকে, উত্তাপে এই মুক্তি সংগ্রামীরা আজিকার তমসা অতিক্রম করিয়া স্বাধীন সােনার বাঙলার ভাস্কর ভবিষ্যৎকে দেখিতে পান। তাই দুর্গম অরণ্যের মধ্যে ক্লেশকর সামরিক শিক্ষা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ইহারা বাঙলার শিল্প সংস্কৃতির চর্চাকে অব্যাহত রাখিয়াছেন । জঙ্গলের বাঁশ কাটিয়া তাহার ফ্রেমে ফাইলের নানান রঙের কাগজ আঁটিয়া তাহারা প্রকাশ করিতেছেন মুক্তি শিবিরের দেওয়াল-পত্রিকা প্রতিরােধ’। রঙের অভাবে। দেওয়াল পত্রিকার শিরােনামটি লেখা হইয়াছে জঙ্গলের লতা দিয়া। যেখানে মুক্তির যুদ্ধ, সেখানেই কমরেড লেনিন। শিবিরে ঢুকির মুখে একটা কাটা গাছের গুঁড়ি কুড়াল দিয়া চাছিয়া একজন মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী চেষ্টা করিতেছেন বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের, শশাষণহীন রাষ্ট্রের স্রষ্টা লেনিনের প্রতিমূর্তি গড়ার। পশ্চিম পাকিস্তানী একচেটিয়া পুঁজি-সামন্তবাদী-সামরিকচক্রের চরম শােষণ ও জাতিগত পীড়ন হইতে দেশকে মুক্ত করার সংকল্পে দৃঢ় বাঙালী মুক্তি সেনারা যে শােষণহীন সােনার বাঙলার স্বপ্ন দেখিতেছেন। লেনিনের প্রতিমূর্তি রচনার প্রয়াসের মধ্য দিয়া সেই স্বপ্নই যেন প্রতীকীরূপে মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে।
মুক্তিযুদ্ধ ! ১: ১০
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ –জয়বাংলা