রণাঙ্গনের ডায়েরী
বিশেষ প্রতিনিধি সারা বাঙলাদশে আজ এক বিস্তীর্ণ রণাঙ্গন সর্বত্র চলিতেছে প্রতিরােধের লড়াই, মুক্তির সংগ্রাম। দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত মুক্তি সেনারা মরণপণ করিয়া লড়াই করিতেছেন, শত্রুর হাত হইতে ছিনাইয়া আনিতেছেন একটির পর একটি গৌরবময় বিজয়। ময়মনসিংহ জিলার উত্তরাঞ্চলের একটি রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর গত দেড় মাসের তৎপরতা ও সাফল্যের ডায়েরী নিচে দেওয়া হইল। ইহা হইতে সারা বাঙলাদেশের অবস্থা অনুমান করা যাইবে।
৩,৭ জুলাই
হাবিলদার মেজর আফসারউদ্দীন গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ভালুকা থানায় একদল মুক্তিযােদ্ধাকে সংগঠিত করেন। এই কোম্পানির সদস্যসংখ্যা ছিল একশতেরও কম। পাক দালালেরা এই সংবাদ ময়মনসিংহ ও জামালপুরে পাক বাহিনীর দপ্তরে পাঠায়। পাক বাহিনীর দুইটি শক্তিশালী দল ময়মনসিংহ ও জামালপুর হইতে যুগপৎ স্থল ও জলপথে ভালুকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। খবর পাইয়া হাবিলদার মেজর আফসারউদ্দীন ৩রা জুলাই তাহার সৈন্যদলকে বাউলিয়া বাজারের নিকট অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। ৪ঠা জুলাই সকাল ৮টায় মুক্তিসেনারা অতর্কিতে শত্রুর উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে ও তাহাদের মােটর লঞ্চের ক্ষতিসাধন করে। লঞ্চ আরােহী শত্রু সৈন্যদের মধ্যে ৭২ জন মৃত্যু বরণ করে। মুক্তিবাহিনী দুইটি দুই ইঞ্চি মর্টার, তিনটি এল এম জি, বারটি চীনা অটোমেটিক রাইফেল ও ৭১টি অন্যান্য ধরনের রাইফেল হস্তগত করে।
৭ই জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। পাক বাহিনী হেলিকপ্টর যােগে আরও সৈন্য পাঠায় এবং মৃতদেহগুলি উঠাইয়া লইয়া যায়।
১৩ জুলাই।
ল্যান্সনায়েক আবদুল জলিলের নেতৃত্বে বার জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দলকে ১৩ই জুলাই জামালপুর ও ময়মনসিংহের মধ্যবর্তী রেল লাইন ধ্বংস করার জন্য পাঠান হয়। এই দলটি ১৫ই জুলাই পিয়ারপুর ও নরুন্দির নিকট রেল লাইন তুলিয়া ফেলে। একই দিনে ইহারা উক্ত স্টেশন দুইটিকেও ধ্বংস করে। এই দলটি এখনও উক্ত এলাকায় রহিয়াছে এবং সাফল্যের সহিত যােগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করিতেছে। ল্যান্স নায়েক আবদুল কাদের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে একদল মুক্তিযােদ্ধা নিয়া ঘাটাইল থানা
আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর আগমণের খবর পাইয়া পুলিশ পালাইয়া যায়। মুক্তিবাহিনী থানার বারটি রাইফেল অধিকার করে। | ৯ই জুলাই মুক্তিযােদ্ধা জনাব আবু হানিফের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা প্রকাশ্য দিবালােকে ফুলপুর থানা আক্রমণ করিয়া থানার প্রহরীকে হত্যা করে এবং দুইটি রাইফেল, দুইটি ওয়ারলেস সেট ও প্রচুর গােলাবারুদ দখল করে।
১৬ জুলাই। | মুক্তিযােদ্ধা জনাব আবদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩৮ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল ১৬ই জুলাই ময়মনসিংহ ও হালুয়াঘাটের মধ্যবর্তী নাগলা সড়ক সেতু ধ্বংস করিয়া পাক বাহিনীর যােগাযােগ ও সৈন্য চলাচল ব্যবস্থা বিকল করিয়া দেন।
১৭ জুলাই
১৭ই জুলাই মুক্তিযােদ্ধাজনাব ফজলুল হকের নেতৃত্বে ৩৫ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল ময়মনসিংহের অদূরবর্তী বাইগানবাড়ীর গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতুটি ধ্বংস করিয়া উত্তরবঙ্গের সহিত রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলেন।
একই দিনে মুক্তিবাহিনীর দুইটি টহলদারী দল জনৈক সুবেদারের নেতৃত্বে (নিরাপত্তার জন্য নাম গােপন রাখা হইল) অতর্কিকে পাক সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালাইয়া বার জনকে খতম করে।
১৯ জুলাই।
এদিন সকাল পৌনে আটটায় পাক বাহিনী মুক্তিফৌজের তাস্তার ঘাটিতে (নালিতাবাড়ী থানা) হানা দেয়। মুক্তিফৌজের গেরিলারা আত্মগােপন করিয়া থাকিয়া অতর্কিতে পাক সেনাদের উপর ঝাপাইয়া পড়ে এবং তের জন পাক হানাদার দস্যুকে হত্যা করে।
২৭ জুলাই তান্তারের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে পাক বাহিনী ২৭শে জুলাই মুক্তিবাহিনীর অপর একটি ঘাটিতে আক্রমণ চালায়। এবারের লড়াইয়েও ১৬ জন পাক সৈন্য নিহত হয়। ল্যান্স নায়েক মেসবাহউদ্দীন মুক্তিবাহিনীকে পরিচালনা করেন। মেসবাহউদ্দীন বুলেট বিদ্ধ হইয়া বর্তমানে চিকিৎসাধীন রহিয়াছেন। | ২১শে জুলাই একদল মুক্তিযােদ্ধা হালুয়াঘাট থানার অন্তর্গত ডুরাইল পােস্ট-অফিস আক্রমণ করিয়া ভবনটিকে ভস্মীভূত করেন।
সিপাহী জাফর আলীর পরিচালনায় একদল মুক্তিযােদ্ধা ১৫ই জুলাই মুক্তাগাছায় “বদর বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করিয়া তাহাদের পাঁচটি রাইফেল কাড়িয়া নেন। ইহারা পিয়ারপুর রেল স্টেশন। আক্রমণ করিয়া কয়েকজন কুখ্যাত পাক দালালকে হত্যা করেন।
৩০ জুলাই।
ল্যান্স নায়েক আহমদ আলীর নেতৃত্বে বারােজন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল ৩০শে জুলাই দুপুর বারােটায় পাক বাহিনীর একটি টহলদারী দলের উপর আক্রমণ চালাইয়া একজন নন-কমিশনড় অফিসার ও দুই জন সৈন্যকে হত্যা করে।
২২শে জুলাই দুই জন পাকসেনা টালকি ইউনিয়নের রামেরকান্দি গ্রামের জনৈক আবদুল মান্নানের গৃহে চড়াও হইয়া মেয়েদের উপর অত্যাচার করিতে উদ্যত হয়। আবদুল মান্নান অতর্কিত ছুরিকাঘাতে দুই জনকেই জাহান্নামে পাঠাইয়া দেয়।
৩ অগস্ট
৩রা অগস্ট মুক্তিযােদ্ধা জনাব মােজাফফর আলীর নেতৃত্বে মুক্তিফৌজের একটি দল গােয়াতলা গ্রামে রাজাকার ও পাক সেনাদের একটি দলের উপর আক্রমণ চালাইয়া তিনটি রাইফেল দখল করেন।
এক ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধ চলে।
৬ অগস্ট
মুক্তিযােদ্ধা ডাঃ মাহমুদ ও জনাব আবুল হাসেমের পরিচালনায় ৬ই অগস্ট সকাল সাড়ে পাঁচটায় মুক্তিযােদ্ধাদের দুইটি দল বন্দৱকাটা সীমান্ত চৌকিতে হামলা করিয়া ৩০ জন পাক সেনাকে নিহত ও আরও ৩৫ জনকে জখম করেন। মুক্তিফৌজের হতাহতের সংখ্যা মাত্র পাঁচ জন।
মুক্তিযুদ্ধ । ১; ৮ !
২৯ আগস্ট ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ –মুক্তিযুদ্ধ