You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.13 | অসুরপুরে মড়াকান্না | জয়বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

অসুরপুরে মড়াকান্না

মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় অভিযান অব্যাহত মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা গত সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন রণাঙ্গনে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর প্রবল আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। গত ৫ই আগস্ট বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী সিলেটের আলী নগর অঞ্চলে এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১০জন শত্রুসৈন্য খতম করেছেন। এই আক্রমণে আরও ১৫জন সৈন্য আহত হয়। গত ৪ঠা  আগষ্ট মুক্তি বাহিনীর এক প্রচন্ড আক্রমণে কসবা এলাকায় ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। একটি শত্রু সৈন্য গাড়ী ৩টি বাঙ্কার ও দুটি সড়ক সেতু ও ধ্বংস করা হয়। পূর্ব রণাঙ্গণে মুক্তি বাহিনীর গেরিলাযােদ্ধারা মংগলি ফেরীঘাটে আক্রমণ চালিয়ে ফেরী ইঞ্জিন ও নৌকার ক্ষতি সাধন করেন। কানাইঘাটের ফেরী ঘাটে এক আক্রমণে একজন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও ৩ জন আহত হয়। | স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, মুক্তিযােদ্ধারা দশরথের রেজিষ্ট্রী অফিস আক্রমণ করে। সম্প্রতি ২ জন রাজাকার ও মুসলিম লীগের ৩জন গুন্ডাকে খতম করেন। শাকমাগ্রাম ও পাগলায় মুক্তিবাহিনী একটি সড়ক সেতু ও দুটি কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছেন।  দক্ষিণমূল অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে এক সংঘর্ষে ৫ জন হানাদার সৈন্য প্রাণ হারায়। ইসলামপুর ও কমরজানি এলাকায় গেরিলাদের হাতে ৮ জন হানাদার সেনা খতম হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে গত ৩রা আগষ্ট কুমিল্লার সিঙ্গার বিল এলাকায় মুক্তিবাহিনী প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে হানাদার সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়েছেন। ৩ ঘণ্টার এই আক্রমণে চার জন অফিসার ৩৫০ জন দস্যু সৈন্য নিহত হয় এবং ২ জনকে আটক করা হয়। এ ছাড়া একটি মেশিনগানসহ ২০ হাজার রাউন্ড গুলী মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। 

পশ্চিম পাক-সেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রবল বাধা পাওয়ায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কয়েকদিন আগে পাক বিমান থেকে বােমা এবং নৌবহর থেকে গােলাগুলী বর্ষণ করা হয়। তেহরানের দৈনিক পত্রিকা ‘কয়হান ইন্টারন্যাশনাল’-এ আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্যের বক্তব্য এই খবর প্রকাশিত হয়। বাংঙ্গালী হত্যাকারী ও বেলুচিস্তানের নরঘাতক দখলীকৃত বাংলাদেশের সামরিক গভর্নর টিক্কা খান ঐ পত্রিকার সংবাদদাতার কাছে স্বীকার করেছেন যে, পূর্ব বাংলার আইন ও শৃঙ্খলার অবস্থা মােটেই স্বাভাবিক নয়। বাধা আসছে চারদিক থেকেই এবং আন্তর্জাতিক কাজও চলছে। এদিকে পূর্ব রণাঙ্গণ থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, এ সপ্তাহের গােড়ার দিকে। মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে জল্লাদবাহিনীকে দিশেহারা করে তােলে। গেরিলাদের আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা ময়মনসিংহ রেলপথ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।  গেরিলা বাহিনী ময়মনসিংহ জেলায় ৩১শে জুলাই থেকে ২রা আগষ্ট পর্যন্ত মুখােমুখী আক্রমণ। চালিয়ে বহু খান সেনাদের হতাহত করেন। ময়মনসিংহ ও কিশােরগঞ্জের মধ্যকার ট্রেন যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। গেরিলারা বৈদ্যুতিক লাইনও নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে সিলেট শহরের অর্ধেক এলাকা গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেছে।  গেরিলা যােদ্ধারা বাহাদুরবাদ ঘাটে পাক-ফৌজ বােঝাই একটি ট্রেনের বগিতে আক্রমণ করেন। ফলে বহু সৈন্য হতাহত হয়। তাদের আক্রমণে দুটি রেল ইঞ্জিন, বেশ কয়েকটি ওয়াগন এবং যাত্রীবাহী কোচ ক্ষতিগৃস্থ হয়। ২রা আগষ্ট দেওয়ানগঞ্জ শহর আক্রমণ করেন। হানাদার সৈন্যরা ষ্টেশনে আশ্রয় নিলে মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। দস্যু সৈন্যরা পালিয়ে কোন রকমে প্রাণ বাঁচায়। রাজাকারদের দুইটি ট্রেনিং ক্যাম্প ও ধ্বংস করে দেয়া হয়।

গত ২রা আগষ্ট কাইয়ুমপুরে মুক্তিবাহিনীর এক অতর্কিত আক্রমণে ১০জন খান সেনা নিহত এবং ৪ জন মারাত্মক ভাবে আহত হয়। এই অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর টহলদানরত সেনাদের উপর অপর এক আক্রমণে ২জন সৈন্য খতম হয়। বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, দখলীকৃত বাংলাদেশে এস, এস, সি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য পাক। সামরিক সরকার যে প্রচেষ্টা চালায় তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। ঢাকার মতিঝিল সরকারী বিদ্যালয়ে কিছু  কিছু অবাঙ্গালী ছাত্র পরীক্ষা দিতে গেলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা গ্রেণেড দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে প্রশ্নপত্র ও খাতা ভস্মিভূত এবং ভবণের ক্ষতি সাধন করেন। ফলে ঐ কেন্দ্রে আর কোন পরীক্ষা হতে পারে নাই। মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা গত ৩রা আগষ্ট তারিখে সিলেটের দক্ষিণ অঞ্চলে দুই প্লাটুন খান সেনার উপর এক প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে ৫০ জন দস্যুসৈন্যকে হত্যা করেছেন। মুক্তিযােদ্ধারা একটি মেশিনগান, একটি হাল্কা মেশিনগান, ৬টি বন্দুকসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দখল করে নিয়েছেন। এছাড়া ২জন দুশমন সৈন্যকে জীবন্ত অবস্থায় আটক করা হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ।

গত ২রা আগষ্ট মুক্তিযােদ্ধারা শালদা নদীতে দখলদার সৈন্যবাহী সাতটি নৌকার উপর এক অতর্কিত হামলা চালায ফলে ৫টি নৌকা ডুবে যায় এবং ৯০ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয়। সম্প্রতি মুকুন্দপুরে এক আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৪৩ জন পাক-ফৌজ নিহত হয়। গেরিলাযােদ্ধারা কাইয়ুমপুরে শত্রু সৈন্যবাহী একটি নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছেন। এখানে ১৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রাণ হারায়। | নােয়াখালীতে মুক্তিযােদ্ধারা ৮জন রাজাকারকে হত্যা করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেন। সম্প্রতি গেরিলা যােদ্ধারা রায়পুরার কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা সাবেক পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী মােতালেব ভূইয়াকে গুলী করে হত্যা করেছেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। গেরিলা স্কোয়ার্ড নিউমুড়িং এলাকায় একটি কয়লা ডিপাে ভস্মীভূত করেন। ১৯ নম্বর জেটির কাছে একটি পাকিস্তানী জাহাজ গেরিলাযােদ্ধারা ডুবিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গোপসাগরে বহির্ণোঙ্গর অবস্থায় একটি পাকিস্তানী ট্যাঙ্কারের উপর আক্রমণ চালিয়ে গেরিলযােদ্ধারা ট্যাঙ্কারটির মারাত্মক ক্ষতি করেন। এ সপ্তাহে শত্রু সেনার ক্ষয়ক্ষতি ; ২ শত সৈন্য নিহত, ৪ জন দালাল খতম, ৭টি সেতু ধ্বংস, ৯টি অস্ত্র দখল।

জয়বাংলা (১) ৫১; ১৪ 

১৩ আগস্ট ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯ –জয়বাংলা