নদীগুলোর কারণে ঢাকা ছিলো কঠিন এক দুর্গ
পরিকল্পনার বিবর্তন
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/niazi-map.pdf” title=”niazi map”]
পূর্ববঙ্গের ভূমি নিচু, সমতল, জলাভূমিতে পূর্ণ এবং অজস্র নদী ও খাল দিয়ে বহুধাবিভক্ত। সাধারণভাবে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবহমান প্রশস্ত নদীগুলাে নিম্নাঞ্চলে জোয়ার-ভাটা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এই ভূখণ্ডের বড় একটি অংশ প্লাবিত থাকে। চাষযােগ্য জমি অসংখ্য আল দিয়ে ছােট ছােট খণ্ডে বিভক্ত। এসব জমিতে মূলত ধান আর পাটের আবাদ হয়। পূর্বদিকে পাহাড়ি এলাকায় কিছু চা উৎপন্ন হয়। সাধারণত মে মাসের শেষের দিকে বর্ষাকাল শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ থাকে। উত্তরের তুলনামূলকভাবে উচু এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা হয় এবং এর ফলে কোনাে কোনাে নদী কয়েক মাইল পর্যন্ত প্রশস্ত হয়ে যায়। এখানকার প্রধান নদীগুলাে হল গঙ্গা যা এখানে পদ্মা নামে পরিচিত, যমুনা স্থানীয়ভাবে যা ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা । প্রতি বছর বর্ষায় পুরাে ভূখণ্ডের বিশাল একটি অংশ ব্যাপকভাবে ডুবে যায় এবং বর্ষার পানি নেমে যাবার পর মাটি শুকোতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যায়। বাঁধানাে রাস্তা ছাড়া। যানবাহন চলাচল তখন খুবই দুরূহ আর মাঠের মধ্যে দিয়ে চলাচল তাে প্রায় অসম্ভব। সহজবােধ্য কারণেই প্রশস্ত নদী, খাল-বিল, বন-জঙ্গল ও ধানক্ষেত এবং অপ্রচুর রাস্তাঘাট ও রেলপথের কারণে এই ভূখণ্ডে নিজেদের দখল বজায় রাখা খুবই সহজ। নদীগুলাের ওপরে ব্রিজের সংখ্যাল্পতা আক্রমণের কাজ আরাে কঠিন করে তােলে। ফেরিই নদী পারাপারের একমাত্র যথাযথ উপায়। এসব অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কারণ শুধু সৈন্য নয়, তাদের সাথে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, রসদ, ইত্যাদিও একাধিক নদী পার করতে হয়। আমাদের সৌভাগ্য, পাকিস্তানিরা মূলত শহরগুলােতেই আস্তানা গেড়েছিল। নদী পারাপারের প্রবেশমুখে পাহারা বসালে আমরা হয়ত নদীও পার হতে পারতাম না, ঢাকাতেও পৌছাতে পারতাম না। নদীগুলাের গতিপথ সম্পূর্ণ ভূখণ্ডটিকে চারটি সেক্টরে বিভক্ত করেছে। গঙ্গা বা পদ্মার উত্তরাঞ্চল এবং ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে উত্তর-পশ্চিম সেক্টর। এর অন্তর্ভুক্ত প্রধান শহর দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও রাজশাহী। পদ্মার ওপরের হার্ডিঞ্জ (Hardinge) রেলওয়ে ব্রিজ দিয়ে পশ্চিম সেক্টরের সাথে এই সেক্টর সংযুক্ত। উত্তরে এর শেষ প্রান্তে শিলিগুড়ি (Siliguri)-র সরু করিডর। সারা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে সড়ক ও রেল যােগাযােগে এই করিডরের গুরুত্ব অপরিসীম।
পদ্মার দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে পশ্চিম সেক্টর। এতে অন্তর্ভুক্ত প্রধান শহর যশাের, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও নদীবন্দর খুলনা। মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর। এই সেক্টরভুক্ত প্রধান শহর সিলেট, কুমিল্লা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম । ব্রহ্মপুত্রের পূর্বাঞ্চল ও মেঘনার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত উত্তর-পূর্ব সেক্টর। এর অন্তর্ভুক্ত প্রধান শহর রাজধানী ঢাকা ও ময়মনসিংহ। আমার ধারণা ছিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অধিকৃত সমগ্র এলাকা রক্ষা করার চেষ্টা করবে। ভারতীয় লক্ষ্য যেহেতু উল্লেখযােগ্য একটি অংশ দখল করে সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত করা, পাকিস্তানিরা সেই হিসেব অনুযায়ী নিশ্চিতভাবেই অন্তত প্রধান শহরগুলাে রক্ষার চেষ্টা করবে। পরবর্তীতে আমার এই অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হয়, যখন পাকিস্তানিরা প্রাথমিকভাবে সেই শহরগুলাের প্রবেশপথে ও পরে খােদ শহরগুলােতেই প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করে। এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের ভূ-কৌশলগত (geostrategic) ও ভূ-রাজনৈতিক (geopolitical) প্রাণকেন্দ্র ঢাকা। ফলে, যে কোনাে অপারেশনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ঢাকা দখল করা। অন্য সেক্টরগুলাে সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এ’রকম যে, অন্যান্য শহর দখল করতে গেলে অনেক সময়ের দরকার এবং এতে প্রচুর প্রাণহানিও ঘটবে। অথচ এর পরিবর্তে আমরা যদি গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগের প্রাণকেন্দ্রগুলাে দখল করতে পারি, তাহলেই পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং তাদেরকে আমরা হটে যেতে বাধ্য করতে পারব। উত্তর-পশ্চিম সেক্টরে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের সমস্ত যােগাযােগের প্রাণকেন্দ্র ছিল বগুড়া এবং সেই একই কারণে আমাদেরও অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল বগুড়া। হিলি-গাইবান্ধা প্রধান সড়কই ছিল বগুড়াতে পৌছার সহজ পথ এবং এই কারণেই এখানে শক্ত প্রতিরােধের সম্মুখীন হবার আশঙ্কা। আরাে কয়েকটি পথ অবশ্য ছিল, কিন্তু সেগুলােতেও প্রতিরােধ ছিল অনিবার্য। সৌভাগ্যক্রমে পরবর্তীতে আমরা আপ-টুডেট ম্যাপ পাবার পর ফুলবাড়ির কাছাকাছি একটা জায়গা থেকে বগুড়ার উত্তরে পীরগঞ্জ পর্যন্ত শুকনাে মৌসুমে যানবাহন চলাচলের উপযােগী একটা রাস্তা চিহ্নিত করি। এই পথ ব্যবহার করে পাকিস্তানি প্রতিরােধকে পাশ কাটিয়ে উত্তরদিক থেকে বগুড়াতে প্রবেশ করা সম্ভব। পশ্চিমে যাবতীয় যােগাযােগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল যশাের। এখান থেকে রাস্তা চলে গেছে ফরিদপুরের সেই জায়গা পর্যন্ত, যেখানে ঢাকার দিকে যাবার জন্য পদ্মার ওপরে একটি ফেরিঘাট আছে। মাঝে অবশ্য ঝিনাইদহ এবং মাগুরাতেও দুটি যােগাযােগকেন্দ্র ছিল। যশােরকে উত্তরদিক থেকে পাশ কাটিয়ে আসা সম্ভব ছিল এবং ফরিদপুরে নদীর অপর পারে ঢাকায় আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য ঘাঁটি স্থাপন সম্ভব ছিল । দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টরে চাঁদপুর থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত মেঘনা নদীর নিয়ন্ত্রণ লাভ ছিল অত্যন্ত জরুরি। এর ফলে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এছাড়াও এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকলে ঢাকায় অপারেশন পরিচালনা করা সহজ হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জায়গা ছিল চাঁদপুর, দাউদকান্দি ও আশুগঞ্জ। এই সেক্টরের উত্তরে যােগাযােগ-কেন্দ্র ছিল মৌলভিবাজার ও শমশেরনগর এয়ারফিল্ড। সিলেটকে এমনিতেই সহজে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব ছিল। ফলে জরুরি ভিত্তিতে এই শহর দখলের তেমন প্রয়ােজন ছিল না। চট্টগ্রাম দখলও ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কারণ বন্দরটিকে কার্যকরভাবে অবরুদ্ধ করার সামর্থ্য আমাদের শক্তিশালী নৌবাহিনীর ছিল। এছাড়াও এর অবস্থান পূর্বদিকে শেষ প্রান্তে হওয়ায় এর সামরিক গুরুত্ব ছিল খুবই নগণ্য। ভূ-রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় প্রবেশ ছিল কঠিন ব্যাপার। ব্রহ্মপুত্র, পদ্ম ও মেঘনা – সবগুলাে নদীই কয়েক মাইল করে চওড়া। পাকিস্তানি ম্যাপে চিহ্নিত উত্তরে যে ব্রহ্মপুত্র ভারতীয় ম্যাপে চিহ্নিত যে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়েছে, সেটাও অনেক প্রশস্ত। উত্তর-পশ্চিমের বগুড়া-ফুলছড়িঘাট অক্ষরেখা ধরে এসে ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করেও ঢাকায় প্রবেশ সম্ভব। আর উত্তরদিক থেকে হলে ঢাকায় আসতে হবে জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে। এছাড়াও পশ্চিম সেক্টরের ঝিনাইদহ-মাগুরা-ফরিদপুরগােয়ালন্দঘাট হয়ে ঢাকায় পৌঁছানাের আরেকটি পথ আছে। এক্ষেত্রে প্রধান বাধা প্রথমে মধুমতি ও পরে পদ্মা নদী। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসার অর্থ মেঘনা ও লক্ষ্যা নদী অতিক্রম করা দুটোই খুব প্রশস্ত।
Reference:
সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা একটি জাতির জন্ম – লে জেনারেল জে এফ আর জেকব