মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় অভিযান অব্যাহত
হানাদার দস্যুদের সমুচিত জবাব দিচ্ছেন আমাদের বীর সৈনিকেরা
মুজিবনগর, ১০ই জুলাই।
অপরাজেয় বাংলার অগ্নিসেনা মুক্তি যােদ্ধারা পাক জঙ্গী শাহীর ঢাকা চট্টগ্রামের মধ্যে রেল চলাচলের অন্তসার শূন্য দাবী ভুল প্রমাণ করেছেন। বীর মুক্তি যােদ্ধারা নােয়াখালী জেলার স্থানে স্থানে রেলসেতু, সড়ক সেতু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে এবং রেল লাইন উঠিয়ে ফেলায় জঙ্গশাহীর ঢাকা চট্টগ্রামের মধ্যে ট্রেন চালানাের দুঃস্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। | নােয়াখালী থেকে বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে নােয়াখালী সেকটর বীর মুক্তি যােদ্ধারা মাতৃভূমির পবিত্র মাটি থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে সাফল্যজনক ভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে দস্যু বাহিনীর বহু সৈন্যকে হতাহত করেছেন। গত ১৯শে জুন মুক্তিযােদ্ধারা নােয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কে টহলদার দস্যুবাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১৫ জনকে ঘটনাস্থলেই যমপুরীতে পাঠিয়ে দেন আর ১০জন চাচা আপন বাঁচা অবস্থায় চম্পট দেয়। তাদের ট্রাকটি বঙ্গ শার্দূলরা ধ্বংস করে দেন। এর পর কাপুরুষ পাক সেনারা স্থানীয় এলাকার কয়েকটি বাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে তাদের পশু শক্তির স্বাক্ষর রাখে। ২০শে জুন মুক্তিযােদ্ধারা সােনাইমুড়ী থেকে আধ মাইল উত্তরে একটি রেল সেতু উড়িয়ে দেন। তাতে চৌমুহনী-লাকসাম রেলপথ যােগাযােগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পাক দস্যুরা এরপর রেল। লাইনটি পুনরায় মেরামত করার প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কে এই সময়। মুক্তি বাহিনী দস্যুবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩০ জনকে খতম, তাদের ২টি জীপ এবং ১টি ট্রাক। ধ্বংস করেছেন। বীর মুক্তি যােদ্ধাদের এই সাফল্যে স্থানীয় এলাকার জনসাধারণ খুবই উল্লসিত হয়েছেন। বজরা রেলওয়ে স্টেশনের আধমাইল দক্ষিণে চৌমুহনী লাকসামের মাঝে একটি রেলসেতু মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়া, এই রেল সেতুর উভয় পাশের আধ মাইল করে রেললাইন উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে দুষমন পাক সৈন্যদের রেল যােগাযােগ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চন্দ্রগঞ্জ রেল সেতুটিও আংশিক বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে শত্রুপক্ষ তা আবার মেরামত করে ফেলে। ভীমগঞ্জ রায়পুর সড়ক পথে পেনাগাদা—চন্দ্রগঞ্জের মধ্যে কয়েক স্থানে রাস্তাটি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। তবে শত্রুসেনারা পরে উহা মেরামত করে ফেলে।
গত ২৬শে জুন গেরিলারা লক্ষ্মীপুর পুরাতন রাস্তায় একটি সেতু উড়িয়ে দেন। লক্ষ্মীপুর রায়পুর সড়কপথে দুলাল বাজারের নিকট রাস্তাটি বিনষ্ট করে দেয়ায় শত্রুদের রায়পুর যাওয়া ব্যাহত হয়। তাতে রামগঞ্জের শত্রুসেনাদের চলাচল ব্যাহত হয়। ২৬শে জুন মুক্তিবাহিনী লক্ষীপুর বাগবাড়ীতে হানাদার বাহিনীর একটি ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালিয়ে দেড়শত পাক হানাদার সৈন্যকে হত্যা করেন। এই হামলায় হানাদার সৈন্যকে হত্যা করেন। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর আরও দেড়শত সৈন্য আহত হয়। আহতদের মধ্যে আরও ৮’জন মারা যায়। মুক্তি যােদ্ধারা এই হামলায় হালকা মেসিনগান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৩০৩ রাইফেল প্রভৃতি অস্ত্র। ব্যবহার করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লক্ষ্মীপুরের পূর্ব দিকের মদন রেলসেতুটি পূর্বেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। গত ১৮ই জুন মুক্তিযােদ্ধারা নােয়াখালীর সদর মহকুমার পাক হানাদারদের কুখ্যাত গুপ্তচর সেমিয়ার বাড়ী ঘেরাও করে সেরুমিয়ার এক পুত্র এবং তার ৪ জন সশস্ত্র রক্ষীকে হত্যা করেন। সে মিয়া পলায়ন করে প্রাণরক্ষা করে। হানাদারবাহিনীর এই কুখ্যাত দালালের অনুচরদের হত্যা করায় স্থানীয় জনসাধারণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। বাংলাদেশের বীর মুক্তিযােদ্ধারা গত ৪ঠা জুলাই সকালে রাজশাহী শহরে হানাদারদের একটি ট্রাকের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ৭জন দস্যুসেনাকে খতম করেন। | মুক্তি যােদ্ধারা গত ২রা জুলাই কুষ্টিয়া জেলার মহিষকুন্ডিতে ৬জন দস্যু সেনাকে হত্যা করেন। গেরিলাদের আক্রমণে চুয়াডাঙ্গার পুলিশ থানাটিরও ধ্বংস হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বরিশাল এবং পটুয়াখালীতেও মুক্তি যােদ্ধাদের মারমুখী তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের কাছে সুরমা নদীতে পাকিস্যুর একটি রনতরীতে প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করে মুক্তি যােদ্ধারা বহু হানাদার সৈন্যকে খতম করে দেন। গত ২রা জুলাই মুক্তি যােদ্ধারা। সুনামগঞ্জের কাছে অপর এক স্থানে একটি টহলদারী সৈন্য বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করেন। কাপুরুষ পাকদস্যরা বঙ্গকেশরী মুক্তি যােদ্ধাদের স্পর্শও করতে না পেরে উন্মত্ত ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলােতে লুঠতরাজ ও নিরীহ লােকজনের বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দিয়ে পশুবৃত্তি চরিতার্থ করে। ঢাকা বিবিসি প্রচারিত সংবাদে জানা যায় যে, মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ঢাকা-ময়মনসিংহের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষাকারী একটি সড়ক সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। পাক হানাদারদের সঙ্গে মুক্তি যােদ্ধাদের একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে।
মুক্তি যােদ্ধারা ঢাকার উত্তরে শ্রীপুর এলাকার একটি টহলদারী পাক বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে তাদের খতম করে দেন। পাবনা গত ৬ই জুলাই রাতে মুক্তি যােদ্ধারা পাবনা জেলার পক্ষী এবং রাজশাহী জেলার বানেশ্বরে পাক সেনাদের একটি শিবিরে অতর্কিত আক্রমণ করে ১৩জন হানাদার সৈন্যকে খতম করেন। তা ছাড়া গেরিলারা রাজশাহী নাটোর সড়কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। রংপুর। রংপুর জেলার হাতিবান্ধা, বরখাতা এলাকায় একটি টহলদারী পাক সেনা দল মুক্তিবাহিনীর হাতে নিশ্চিহ্ন হয়। ৪ঠা জুলাই দিনাজপুর অঞ্চলে মুক্তি যােদ্ধাগন বহুস্থানে রেল লাইন উড়িয়ে দিয়ে দস্যু সেনাদের চলাচল বিঘ্নিত করেন। | কিছুদিন পূর্বে মুক্তিযােদ্ধাগণ খুলনা জেলার একটি থানা আক্রমণ করে পাঞ্জাবীদের সাহায্যকারী। জনৈক দারােগা এবং কয়েকজন পুলিশকে হত্যা করে কয়েকটি রাইফেল ছিনিয়ে নেন।
জয়বাংলা (১)১: ১০
১৬ জুলাই ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ –জয়বাংলা