আমাদের বাঁচাও, আরও সৈন্য, গােলা পাঠাও – মুক্তিফৌজবেষ্টিত পাক সেনাদলের আর্ত বার্তা | জয়বাংলা | ২ জুলাই ১৯৭১
পাক সেনাবাহিনীর মেজর ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা নিয়ে উধাও আমাদের বাঁচাও, দ্রুত আরও সৈন্য ও গােলাবারুদ পাঠাও। তিনদিক থেকে মুক্তি ফৌজ মর্টার ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে দখলদার সামরিক হেডকোয়ারটারের উদ্দেশে একটি পাক সৈন্য ইউনিটের এই আর্ত চীৎকার গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনিটারে ধরা পড়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশে দখলদার সামরিক কনট্রোলের কাছে প্রেরিত আরও কয়েকটি বার্তা ও রেডিওগ্রাম মনিটারের মাধ্যমে ধরা পড়ায় এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে সেখানকার সব স্বাভাবিক বলে সামরিক কর্তারা হরদম যে প্রচার চালাচ্ছে ত ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। আরও বােঝা যায় যে, সব চাইতে যেটা সেখানকার সামরিক কর্তৃপক্ষকে বেশি করে ভাবিয়ে তুলেছে তা হচ্ছে মুক্তি ফৌজের ক্ষিপ্রগতি আক্রমণের অনিশ্চিয়তা। ওই সব বার্তা থেকে এও বােঝা যায় যে বাংলাদেশের সব স্বাভাবিক নয়। সামরিক অফিসারদের মধ্যে লুটতরাজের প্রবণতা ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে জনৈক অফিসার কিছুকাল হল এক ব্যাংক থেকে ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা তুলে সেই থেকে উধাও হয়েছেন বলে মনিটার করা এক বার্তায় ধরা পড়ে। পাক সামরিক প্রশাসনের অব্যবস্থা সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষের মাত্রা দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে।
প্রথম যে বার্তাটি (কল নং ৬২) মুক্তিফৌজ মনিটর করে ধরে তাতে বলা হয় যে, পাকিস্তান বাহিনীর একটি ইউনিটের লােকেরা গত দুমাস ধরে বেতন পায় নি। ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান অর্থনীতির উপর নানা কারণে ক্রমশঃ চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে নিযুক্ত পাক সৈন্যরা গত কয়েক মাস থেকে নিয়মিত বেতন পাচ্ছে না এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে নিয়মিত টাকাও পাঠাতে পারছে না। এর ফলে পাক বাহিনীর বেশ কিছু লােকের মধ্যে অসন্তোষ ধুমায়িত হয়ে উঠেছে। আর একটি বার্তা দখলীকৃত বাংলাদেশের একজন অফিসারের কাছ থেকে আর একজন সামরিক অফিসারের কাছে প্রেরিত একটি রেডিওগ্রাম। এ বার্তায় বলা হয় যে, জামসেদ নামে একজন আই-জি আর একজন সামরিক অফিসারকে জানাচ্ছেন, ২৯ এপ্রিল মেজর মাদৃত নামে একজন সামরিক অফিসার একটি ব্যাংক-এ গিয়ে ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা তােলেন এবং সেই থেকে উধাও হন। সামরিক কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত না সে অফিসার না সে টাকার হদিশ করতে পেরেছে। বৃহস্পতিবার সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া এক সংবাদে আরও জানা যায় যে, রংপুর মনকাচরের কাছে এক নৌ-সংঘর্ষে পাক বাহিনীর কাছ থেকে মুক্তি ফৌজ তিনটি স্পিড বােট ছিনিয়ে নেয়। গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক সংবাদে আরও জানা যায় যে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ১৩৫০ মাইল আসাম ও মেঘালয়ের ৬২০ এবং ত্রিপুরার সঙ্গে ৫৭৫—মােট এই ২৫৪৫ মাইল সীমান্ত স্থায়ীভাবে দখলে এবং বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সামরিক প্রশাসন বজায় রাখতে মােট ৭ ডিভিশন সৈন্য দরকার বলে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ মনে করছেন। বর্যা শুরু হয়েছে এবং বর্ষণ প্লাবনের দুর্যোগে গেরিলা বাহিনীর অনিশ্চিত আক্রমণকে পর্যুদস্ত করার জন্য পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৫ ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের জন্য আরও ৩ ডিভিশন সৈন্য ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তােলা হচ্ছে।
ওই সূত্রে আরও জানা যায় যে, বাংলাদেশের জন্য এই বিপুল বাহিনীর ব্যয় বহন পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষকে এক বিরাট সঙ্কটের মুখােমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। প্রতি ডিভিশনে সাধারণ সৈন্য ও অফিসার মিলে ১৬,০০০। মাথাপিছু বেতন ছাড়া অন্যান্য ব্যয়ের পরিমাণ মাসিক ৭০০ টাকার মত পড়ছে। এ হিসাবে প্রতি ডিভিশনের জন্য মাসিক ব্যয় হচ্ছে ১ কোটি ১২ হাজার টাকা। ৫ ডিভিশনের জন্য মাসিক ব্যয় হচ্ছে ৫ কোটি টাকার উপর। বেতন বাবদ ব্যয়ও ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার মত। এ ছাড়া আরও তিন ডিভিশন সৈন্যবাহিনী গড়ে তােলার ব্যয়ও কয়েক কোটি টাকা। এই বিপুল ব্যয়ভার বহন করা ক্রমশঃ পাকিস্তান সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে বলে ওই সূত্রে জানা যায়। ওই সূত্রে পাকিস্তানে অর্থনেতিক সঙ্কট ঘনিয়ে আসার ব্যাপারে ৪টি কারণের উল্লেখ করা হয় – (১) বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর দখল বজায় রাখার ব্যাপারে সৈন্যদের খাদ্য, রসদ ইত্যাদি পাঠানাের ক্রমবর্ধমান অসুবিধা। কারণ মুক্তিফৌজ অনেক অঞ্চলে রেল, সেতু ইত্যাদি উড়িয়ে দিয়েছে, পথঘাটের ক্ষতিসাধন করে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে তুলেছে। (২) চা, পাট, চামড়ার উৎপাদন ও ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে। (৩) পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প ব্যবসায় বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছে। কারণ সেখানকার শিল্প ব্যবসা বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল এবং (৪) পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্য, ঋণ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং ক্রমশ বন্ধ হতে চলেছে।
জয়বাংলা (১) ! ১; ৮
২ জুলাই ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ –জয়বাংলা