পাঁচ সপ্তাহের যুদ্ধে দশ সহস্র পাক সৈন্য নিহত
কয়েক সপ্তাহের ফল
গেরিলা যুদ্ধ এখন বাংলার প্রতি স্থানে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী দখলদার পাক-ফৌজের ওপরে ক্রমাগত প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। তাদের চাপের তীব্রতার ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পুনর্দখল হচ্ছে । ইতিমধ্যে রামগড়, টাঙ্গাইল, ছাগলনাইয়া প্রভৃতি কতকগুলি অঞ্চল থেকে পাক-সৈন্যকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এবং অন্যান্য সেক্টরে দখলদার সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। মুক্তিফৌজের এক হিসাবে প্রকাশ, এ পর্যন্ত তাদের হাতে ১০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী ভাড়াটে সৈন্য নিহত হয়। এবং ২০ হাজার আহত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েক শত পদস্থ সামরিক অফিসারও রয়েছে।
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার এবং ছাত্র-তরুণদের দ্বারা গঠিত এই মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতার সাফল্য-স্বরূপ ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রামগড় দখলে এসেছে। মুক্তিসংগ্রামীদের পক্ষে এটা একটা বড় রকমের জয়। শহরটি মুক্তিফৌজের দখলে আসার আগে পাকবাহিনীর সঙ্গে কয়েক দফা বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। পাকফৌজের বহু সৈন্য এইসব আক্রমণে নিহত। বাঙলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে নােয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংযােগ কেন্দ্র ছাগলনাইয়াতে। তিন দিন ধরে পাকিস্তানী ফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড সংগ্রামের পর মুক্তিফৌজ এ জায়গাটি দখল করে নেন।
এই যুদ্ধে অন্ততঃ ২১জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। মুক্তিফৌজ মেশিনগান, রাইফেল, রকেটনিক্ষেপক প্রভৃতি প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাগুলি পলায়মান পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে দখল। করেছেন। এছাড়া এই জেলারই ফেনীঘাটা সেতুর কাছে মুক্তিফৌজের কমান্ডাে বাহিনীর আক্রমণে আরও পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে।
বেনাপােল সীমান্তের ঝিকরগাছায়-
বেনাপােল সীমান্তের ঝিকরগাছায় কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। মুক্তিফৌজ মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাকফৌজের এখানে শত্রু সৈন্যকে গেরিলা কায়দায় তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাকফেীজ বেকায়দায় পড়ে বেপরােয়াভাবে মেশিনগান ও দূরপাল্লার কামান ছুঁড়তে থাকে। মুক্তিফৌজের প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে বহু পাকসেনা নিহত হয় এবং রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পলায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিফৌজের সতর্ক দৃষ্টির ফলে কয়েকজন পাক সৈন্য গ্রেফতার হয়।
পাকফৌজ পিছুহটার সময় পথিপার্শ্বের ঘর-বাড়ীতে অগ্নিসংযােগ ও মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। তাদের বর্বরােচিত হামলায়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, এমন কি ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও রেহাই পায়নি। | কুমিল্লার কসবা অঞ্চলে মুক্তিফৌজ পশ্চিম পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর উপর দুইদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমণ চালায়। মুক্তিফৌজের অল্পসংখ্যক সদস্যের এই হামলায় পাকফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বিমান হামলার সাহায্য নিয়েও এঁটে উঠতে পারেনি। এই আক্রমণে পাকফৌজের বহু সেনা মুক্তিফৌজের হাতে হতাহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্য পলায়ন করে।
মুক্তিফৌজ বাঙলাদেশের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে শত্রুবাহিনীর গতিরােধ করে। এবং তাদের টাঙ্গাইলের জেলা সদর দফতর থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে। প্রাপ্ত অপর এক খবরে প্রকাশ, ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছায় মুক্তিফৌজ পাক সৈন্যদের সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তাছাড়া মুক্তিফৌজ কুমিল্লা অঞ্চলের মিয়াবাজার ও বিবিরবাজারে প্রচণ্ডভাবে শত্রুদের পর্যদস্ত করে। কুমিল্লা জেলায় শাহবাজপুরের গুরুত্বপূর্ণ পুলটি পুনর্দখলের চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীকে সাফল্যের সঙ্গে হটিয়ে দেয় । ৯০ নম্বর সড়কের ওপর শাহবাজপুর পুলটি অবস্থিত এবং এই সড়ক চট্টগ্রাম ও ফেণীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বাঙলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মুক্তিফৌজ ফুলবাড়ী ও দিনাজপুরের মধ্যে সংযােগরক্ষাকারী সড়ক বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।
রংপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজ
রংপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজ মােগলহাট ও অমরখানে গেরিলা পদ্ধতিতে পাক-বাহিনীর ওপর আঘাত হানে। মুক্তিফৌজ এই অঞ্চলে বহু পাক সৈন্যকে হতাহত করেছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটগুলাে অমরখানা ও পাঁচগড়ের মধ্যে জগদ্দল থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে জগদ্দল দখল করে নিয়েছেন। মুক্তিযােদ্ধারা জগদ্দল ও পাঁচগড়ের সংযােগরক্ষক একটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা তেঁতুলিয়া ও ঢাকার মধ্যে সড়ক সংযােগও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। রংপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে যারা নিহত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে মসজিদের দুজন ইমামও আছেন।
পূর্বাঞ্চল সেক্টরে মুক্তিফৌজের চাপ অব্যাহত রয়েছে। এখানে পাকফৌজের ১শত সৈন্যকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। আখাউড়ায় আরও ৫০ সৈন্য নিহত হয়েছে। বেনাপােলের অপর এক খবরে প্রকাশ, মুক্তিফৌজের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট বাহিনী বেনাপােল সেক্টরে প্রচণ্ড চাপ অব্যাহত রাখেন। এই আক্রমণে মুক্তিফৌজ মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল ব্যবহার করেন। ফ্রন্টে পাকফেীজের ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং ২৫ জন দখলদার সৈন্যকে হত্যা করা হয়।
জয়বাংলা (১) ১ ১
১১ মে ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯ –জয়বাংলা