আমরা সবাই বাঙালী
পাশাপাশি মন্দির, মসজিদ, গির্জা আর বৌদ্ধবিহারের ছবি, নীচে স্পষ্টাক্ষরে সগর্ব ঘােষণা : আমরা সবাই বাঙালী।-অবিশ্বাস্য এই দেওয়ালচিত্র নাকি আজ বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে । বাংলার মানসচিত্রে এই দৃশ্যটা সম্পূর্ণ অভিনব এমন কথা বলার উপায় নাই, বাংলার সাধনার অন্যতম বক্তব্য ছিল এটাই,সবার উপরে মানুষ সত্য। বাস্তবেও এই চিত্রটি দুর্লভ ছিল না, শতকের পর শতক ধরিয়া বাংলার মাটিতে মন্দির মসজিদ সহাবস্থান করিয়াছে। তবু যে থাকিয়া থাকিয়া সংশয় অন্ধকারের ভয়সে শুধু কুটিল রাজনৈতিক চক্রান্তের ফল। আজ চক্রীরা যখন সম্পূর্ণ পরাজিত তখন নূতন যুগের ভােরে বাঙালীর এই আত্মঘােষণার বােধহয় প্রয়ােজন ছিল। শুধু ছবিতে নয়, ছবির বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে বাস্তবে রূপায়নের মহৎ ব্রতও নাকি শুরু হইয়া গিয়াছে। গ্রামে গ্রামে ঢােল পিটাইয়া এই বার্তা রটানাে হইতেছে : লুঠেরারা হুশিয়ার। লুঠের মাল ফেরত দেওয়া চাই। নয়তাে-চরম শাস্তি। লােভে পাপ, আর পাপের বেতন মৃত্যু। বিশ্বময় দর্শকেরা জানেন, বাংলাদেশ যাহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করিয়াছিল যে শুধু একটি বর্বর। সেনাবাহিনী নহে একটি মধ্যযুগীয় বর্বর তত্ত্বকেও বিনাশ করা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশ হইতে পাক হানাদার বাহিনীর উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে জিন্না সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্বেরও মৃত্যু ঘটিয়াছে। বাংলাদেশে অতঃপর হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান লইয়া কোনও স্বতন্ত্র সমস্যা থাকিতে পারে না, দুর্ভাগ্য পরস্পরকে যেমন কাছাকাছি করিয়াছে সৌভাগ্যের মুহূর্তেও তেমনই সকলকে পাশাপাশিই থাকিতে হইবে; এটাই স্বাধীন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নিয়তি। সরকার ঘােষণা করিয়াছেন-বাংলাদেশ হইবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ।
ধর্মের ভিত্তিতে অতএব এখানে বৈষম্যের চিন্তা অবান্তর। তবু মৌখিক প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট। নয়। পুরানাে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়ােজন ছিল আরও কিছু-নূতন রাষ্ট্রের নিয়ামকেরা যে সত্যই নূতন করিয়া ইতিহাস লিখিতে বসিয়াছেন সেটা সকলকে জানাে চাই। মুক্তিযােদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের উদ্যোগ সেদিক হইতে সত্যই এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। যে-বাণীটি প্রচারের জন্য তাঁহারা রাইফেলের সঙ্গে কাধে ঢাক ঝুলাইয়াছেন সেটাও মুক্তিযুদ্ধেরই আর এক দিক। সে ভবিষ্যৎ সমাজের স্বপ্ন তাহাদের ঘরছাড়া করিয়াছিল-তাহারা জানেন-প্রতিটি মানুষ আবার নিজ ঘরে না-ফেরা পর্যন্ত তা অপূর্ণ থাকিয়া যাইবে। কেননা সেই স্বপ্নের সমাজে লুঠেরার স্থান নাই, নাই-বাস্তুহারা। ইয়াহিয়া-ভুঠো চক্র তথা পশ্চিমী দখলদারদের লক্ষ্য ছিল অবশ্য অন্য । তাহারা চাহিয়াছিলেন এক সঙ্গে অনেকগুলি মতলব হাসিল করিতে। সমাজের মাথা বুদ্ধিজীবীদের উচ্ছেদ, হিন্দুদের বিতাড়ন, শূন্য স্থানে ঔপনিবেশিকদের পত্তন এবং আরও নানা চিন্তা। এই কর্মসূচীতে স্থানীয় এবং বহিরাগত লুঠেরাদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ প্রধানত দরিদ্রের দেশ-নিরক্ষর জনসাধারণকে সেখানে নানা প্রলােভনে । লুব্ধ করা খুব কঠিন কাজ নহে। রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি দালালদের এক প্রেরণা অবশ্যই ছিল-অর্থ। সাধারণ মানুষ যে প্রবৃত্তিতে লুঠেরা নহেন, তাহারা প্রমাণও মিলিতেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের আহ্বানে তাহারা নাকি জিনিসপত্র ফেরত দিতেছেন, পূনর্বাসনেও সক্রিয় সহযােগিতা করিতেছেন। বাংলাদেশের এটা আর এক মুখ। বলা নিষ্প্রয়ােজন এই ছবিটি রচনার কৃতিত্ব অনেকখানিই মুক্তিযােদ্ধা আর তাহাদের নায়কদের।
বৃহৎ ঘটনায় অনেক সময় ছােটখাটো সুখ দুঃখ চাপা পড়ে, মুক্তি আনন্দিত হাওয়ায় অনেক দীর্ঘশ্বাস মিশিয়া থাকে। দেশ বিভাগের ক্ষণে উদ্বাস্তুদের কাহিনী স্মরণীয়। ভারত স্বাধীন, পাকিস্তান স্বাধীন। কিন্তু তাহাদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ-নিরুদ্দেশ যাত্রা, অজ্ঞাত ভবিষ্যতের হাতে নিজেদের সমর্পণ । সেদিক হইতে ঢাকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দেশে এই পুনর্বাসন উদ্যোগ এক অনুকরণীয় নজির। দেশের ভিতরে যাহারা ছন্নছাড়া হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন-তাঁহাদের কাছে এটা যেমন পরম আশ্বাস ঠিক তেমনই সীমান্তের এপারে নানা শিবিরে অপেক্ষমান লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর কাছেও। দ্বিধা যদি কোনও মনে এখনও থাকিয়া থাকে তবে তাহা নিশ্চয় এবার উবিয়া যাইবে যাত্রীরা সােৎসাহে স্বদেশের দিকে পা বাড়াইবেন। হানাদার উচ্ছেদের পরও এরকম এটি মানস পরিমণ্ডল গড়িয়া তােলার প্রয়ােজন ছিল । শরণার্থীদের তাঁবুগুলিতে বটেই, তাঁহারা যেসব গ্রামে বা শহরে ফিরিবেন সেখানেও; কেননা নানা দুর্ভাবনা। এইসব প্রশ্ন বিচার করিলে মনে হয় আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভার আয়তন বাড়াইয়াও সঙ্গত কাজই করিয়াছেন। বাংলাদেশে আজ আর সংখ্যালঘু সমস্যা নাই কিন্তু মন্ত্রীসভায় একজন হিন্দুর উপস্থিতি এই মুহূর্তে অবশ্যই অতিরিক্ত আশ্বাস। তবে এসব বহির্লক্ষণমাত্র, আসলবার্তা ওই শখ-নির্ঘোষ। ওই ঘােষণা দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যু-সংবাদ । মৃত্যু-সংবাদ সম্ভবত-প্যান-ইসলামেরও। বাংলাদেশের এই নজির যেমন প্রেরণাদায়ী, ঠিকতেমনই কিছু কিছু ঐশ্লামিক রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চয় অস্বস্তিকর।
২৯ ডিসেম্বর ‘৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা