ধন্য বীর- ভারত
পার্থেনে দেবী অ্যাথিনির যে-মূর্তিটিকে যুগ যুগ ধরিয়া আগন্তুক পথিক ও পর্যটকেরা উৎসুক চোখে দেখিয়া আসিতেছে, সে মূর্তির সুচারু মুখে শােভার সহিত যেন একটি বিষাদের ভাব মিশিয়া রহিয়াছে। অ্যাথিনি হইলেন যুদ্ধের দেবী। তাহার হাতে বল্লম, মাথায় লােহানিৰ্মিত শিরস্ত্রাণের আকারে গঠিত মুকুট। যুগ যুগ ধরিয়া দর্শক মানুষের মনে এই প্রশ্ন আলােড়িত হইয়াছে, যুদ্ধের দেবী অ্যাথিনির মুখে বিষাদের ভাব কেন? ইহা কি মূর্তিরচয়িতা শিল্পীর ইচ্ছাকৃত একটি ভুল? | কিন্তু আজ এই মুহুর্তে কোন-পথিক-দর্শক যদি উৎসুক চোখে, যুদ্ধের দেবী অ্যাথিনির এই মূর্তির দিকে দৃকপাত করেন, তবে তিনি আকস্মিক বিস্ময়ে চমকাইয়া উঠিবেন। তিনি দেখিবেন, দেবী অ্যাথিনির মুখে সেই বিষাদের ভাব আর নাই । যুদ্ধের দেবী অ্যাথিনির মুখের ভাব যেন স্মিত-সমুজ্জ্বল একটি তৃপ্তিতে উদ্ভাসিত। এই বিশ্বের হাজার-হাজার বৎসরের ইতিহাসে কত যুদ্ধ ঘটিয়াছে, কত জনপদ প্রান্তর ও উপত্যকা শােণিতে প্লাবিত হইয়াছে। বিজেতার হর্ষে দিক প্রকম্পিত হইয়াছে, বিজিতের দলিত-মথিত অদৃষ্ট করুণ আর্তনাদ ছড়াইয়াছে। তবু যুদ্ধের দেবী অ্যাথিনির মনে একটি অতৃপ্তি থাকিয়া গিয়াছিল । বিষাদ বর্জন করিয়া তিনি প্রসন্নতায় সুস্মিতা হইতে পারেন নাই। কিন্তু আজ এই প্রথম তিনি সুস্মিতা হইয়াছেন। তাঁহার প্রাণের সবচেয়ে প্রিয় আশার স্বপ্নটি আজ সফল হইয়াছে। আজ তিনি এই বার্তা পাইয়াছেন যে এই বিশ্বে মানবীয় মমতায় ও কল্যাণকামনায় অনুপ্রাণিত প্রথম যুদ্ধটি সফল হইয়াছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু রাজা রঘু দ্বিগ্বিজয় করিয়াছেন। আলেকজান্ডার হ্যানেবল শার্লেমান ও নেপােলীয়ানেরা অজস্র রাজ্য ও রাজার অদৃষ্টের উপর দিয়া নিদারুণ যুদ্ধরথ চালাইয়াছেন। দেশ রক্ষার যুদ্ধও অনেক ঘটিয়াছে কিন্তু বিশুদ্ধ কল্যাণ ও মমতার ব্রতের মত একটি ব্রত হইয়া প্রতিবেশী দেশকে রক্ষা করিবার যুদ্ধ ইতিহাসে এই প্রথম ঘটিল, ভারতের বাংলাদেশ রক্ষার যুদ্ধ। নির্মম অত্যাচারীর সশস্ত্র দৌরাত্ম্য হিংস্র আহাদে মাতিয়া বাংলাদেশের লক্ষ-লক্ষ নরনারী শিশুকে হত্যা করিতেছিল, গণতান্ত্রিক অধিকার চূর্ণ বিচূর্ণ করিতেছিল, অপশাসন ও অতিশােষণের এক করাল উৎসব চালাইতেছিল। আজিকার বীর-ভারত শুধু কল্যানেচ্ছা ও মমতার নির্দেশে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের বন্ধু হইয়া যুদ্ধ করিয়াছে, অত্যাচারী শত্রুকে নির্জিত করিয়াছে। এই বীর-ভারত যেমন করিয়া মানবতার সম্মানের জন্য লড়িয়াছে, তেমন করিয়া অতীতের কোন জাতি কখনও লড়ে নাই । যুদ্ধের দেবী অথিনির এই মূর্তিতে তাহার ওষ্ঠ আজ বােধহয় একটি কথা বলিবার জন্যও কাপিয়া উঠিতেছে। কান পাতিলে শুনিতে পাওয়া যাইবে, তিনি বলিতেছেন, ধন্য ভারত, আজিকার বীর ভারত, হে মহান্ ভারত।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা