পলাইতে পথ নাই
পলাইতে পথ নাই, এবং যম আছে পিছে। বাংলাদেশে পাক-সৈন্যের অদৃষ্ট আজ ঘটনার মধ্যে পড়িয়া যে দৃশ্য সৃষ্টি করিতেছে, তাহাকে সংক্ষেপে ওই কয়েকটি কথায় বর্ণিত করিতে পারা যায়। তিন ডিভিসন সৈন্য, তাহার সঙ্গে থৈবার, রেঞ্জার এবং তােচি স্কাউট, তদুপরি হাজার হাজার সশস্ত্র রাজাকার, বাংলাদেশের জীবনকে যাহারা এই আট মাস ধরিয়া হিংস্র আঘাতে রক্তাক্ত করিয়াছে, তাহারা এখন পলাইবার পথ খুঁজিতেছে, পলায়নের পথে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু পলাইবার পথ নাই। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সতর্ক তৎপরতায় ওই পলায়নপর ফেরুপালের সহস্র গ্লানির কালিমালিপ্ত প্রাণের চতুর্দিকে বিরাট অবরােধ রচনা করিয়াছে। হয় আত্মসমর্পণ করিতে হইবে, নয়তাে মৃত্যুবরণ করিতে হইবে। পরিণাম আজ এই ভাষায় তাহাদিগকে আহ্বান করিয়াছে।
বুঝিতে অসুবিধা নাই, লক্ষ লক্ষ নিরীহ নর-নারী ও শিশু ওই পাক সৈন্যের অস্ত্রাঘাতে নিষ্প্রাণ হইবার শেষ মুহূর্তে যে নিঃশ্বাস ছাড়িয়াছিল, তাহাই নিদারুণ এক অভিশাপ হইয়া হিংস্র পশু-প্রায় অত্যাচারীদের পরিণাম গ্রাস করিবার জন্য জাগিয়া উঠিয়াছে। কোথায় পলাইবে তাহারা? বাংলাদেশের দিনের আলােক শাণিত ছুরিকা হইয়া, রাত্রির অন্ধকার করাল দংঐ মেলিয়া এবং মাঠের বাতাস বিষবাষ্প হইয়া তাহাদের পাপী প্রাণের সব ব্যস্ততা স্তব্ধ করিয়া দিবে। বিশ্বের যাহারা এতদিন তাহাদের ইচ্ছাকৃত অন্ধতা লইয়া পাকপশুদের হিংস্রতাকে না দেখিবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছে, তাহারা আজ দেখিবে যে বিচারদণ্ড হাতে লইয়া স্বয়ং নিয়তি কেমন করিয়া ও কত স্পষ্ট করিয়া পাতকীর বিনাশ সাধন করে, মিথ্যাচারীকে শাস্তি দেয় এবং অত্যাচারীর ঔদ্ধত্যকে পলায়নপর ভীরুতায় পরিণত করিয়া দেয়। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর রণকৌশলের প্রশস্তি করিতে হয়। মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হয়, তাহারা শত্রুকে অবরুদ্ধ করিবার অতি চমৎকার কৃতিত্বের এবং বস্তুত অতুলনীয় দক্ষতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন। | যে শত্রু-সৈনিক আত্মসমর্পণ করিবে, তাহাকে বন্দী করিয়া জেনেভা কনভেনসনের বিধি নির্দেশ অনুযায়ী। কয়েকটি সুবিধার ব্যবস্থা পাইতে দেওয়া হইবে। ভারতীয় সেনাপতি ইহা ঘােষণা করিয়া দিয়াছেন । প্রশ্ন থাকিয়া যায়, যে ক্ষেত্রে সৈনিকেরা নিরীহ নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকের যথেচ্ছ প্রাণ সংহার করিয়াছে, নারীর সম্মান ধর্ষিত করিয়াছে, গৃহদাহ, লুণ্ঠনের হিংস্র উৎসবে মাতিয়াছে, তাহারা বন্দী হইবার পর সত্যই যথার্থ বন্দী সৈনিক’ বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে কি? পারে না বলিয়া মনে হয় । সৈনিক হইয়া যাহারা সাধারণ নাগরিকের ঢালাও হত্যা নির্যাতন সম্পন্ন করে, তাহারা সাধারণ ঘৃণ্য খুনী ও ডাকাতের চেয়েও বেশী। মানবতাবিরােধী অপরাধী বলিয়া বিবেচিত হয়। তাহাদের বিশেষ বিচার এবং বিশেষ শাস্তি প্রয়ােজন। পাকসৈন্য বাংলাদেশের জনজীবনের উপর যে অত্যাচার করিয়াছে তাহা বিশ্বের ইতিহাসে জঘন্যতম হিংস্রতা ও পাপাচারের অনুষ্ঠান।
১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা