You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.07 | স্বীকৃতির তিলক বাংলাদেশের ললাটে - সংগ্রামের নোটবুক

স্বীকৃতির তিলক বাংলাদেশের ললাটে

নূতন একটি জাতির জন্ম হইয়াছিল আগেই, ভারত এইবার স্নেহের টানে ও সত্যের প্রয়ােজনে তাহার ললাটে স্বীকৃতির তিলক পরাইয়া দিল। প্রতিবেশীর হাতে প্রথম অভিষেক। সােমবার সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ঘােষণাটি ঐতিহাসিক- ইতিহাস পাতা উল্টাইয়া চলিয়াছে, কোনও কোনও পৃষ্ঠা সে আবার ছিড়িয়া নূতন করিয়া লিখিয়াও লইতেছে । পঁচিশ বছর আগে ‘অখণ্ড ভারতের খণ্ডন একটা ইতিহাস। আজ খণ্ডিত হইল তাহারই খণ্ডাংশ পাকিস্তান। ভারতের দৃষ্টিতে এই দেশ খণ্ডিত হইয়া গিয়াছে মার্চ মাসের পচিশ তারিখেই- পুরাতন অর্থে পাকিস্তান কবেই মৃত- তবু কোনও রাজনৈতিক একটি সমাধানের জাদুতে যদি দুই ভাগ জুড়িয়া যায়, ভারত দীর্ঘকাল সেই প্রতীক্ষাও করিয়াছে। কেননা তাহার মনে তাে পাকিস্তানকে চূর্ণ করার কোন বাসনা ছিল কিন্তু পিণ্ডির নায়কত্রের বাসনা ছিল অন্যরকম । তাহার শেষ পর্যন্ত ন্যায়ের পথ হইতে বিমুখ থাকিয়াছে, যাহা সত্য এবং যাহা অনিবার্য তাহার দিকে চাহিতে তাহাদের রুচি বা সাহস ছিল না। জেদের পরিণাম ডাকিয়া আনিয়াছে চূড়ান্ত মুহূর্ত। ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তান এখন সরকারি ভাবেই “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ”। নূতন সরকারকে অভিনন্দন। বাংলার নামে এতদিন একটি উপসাগর ছিল, এখন জলের সঙ্গে যুক্ত হইল স্থল | বাঙালী একটি দেশ পাইল। “জয়হিন্দ” ধ্বনির সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে “জয় বাংলা”। নূতন জাতির এই অভিষেকক্ষণে আনন্দের সঙ্গে স্বতই মিলিয়া যাইতেছে বেদনা, এই জাতির যিনি জনক, ওই “জয় বাংলা” মন্ত্রের যিনি উদ্গাতা তাঁহার স্মরণে। মুজিব এখন কোথায়? তাঁহার দেশ মুক্ত হইতে আর দেরি নাই, তিনি। মুক্ত হইবেন কবে? তার চেয়েও বড় কথা তিনি কি জীবিত? 

বাংলাদেশের স্বীকৃতি একটি মানবিক সত্যেরই স্বীকৃতি মাত্র। ভারতের পক্ষে এই সিদ্ধান্তটাও সামান্য একটি ঘটনা নহে। চীনকে মানিয়া লইতে কোনও কোনও দেশের তাে লাগিয়া গিয়াছে পাক্কা বাইশটি বছর। ভারত সরকার মাত্র আট মাস অপেক্ষা করিয়াছিলেন। এবারের স্বীকৃতির যতখানি তাৎপর্য তাহার গুরুত্বও ততখানি। দরবার করিয়া অনেক বেলা বহিয়া যাইতেছিল, ইতিমধ্যে পিণ্ডিশাহী সহসা এক যুদ্ধ ভারতের উপর। চাপাইয়া দিল। এবার ভারতের সম্মুখে আর বিকল্প ছিল না, নিজের প্রয়ােজন মতাে ব্যবস্থা লইবার নৈতিক অধিকার নিশ্চয়ই তাহার। আজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমাদের সেনাবাহিনীকে ঢুকিতে হইয়াছে, প্রতিরক্ষার তাগিদে, একটি বন্দি জাতিকে মুক্ত করার দাবিতেও বটে। দুই দেশের বাহিনী পাশাপাশি  পড়িতেছে। হাতে হাত আগেই মিলিয়া ছিল। এই স্বীকৃতি দেখাইয়া দিল বাংলাদেশের ভূমির উপর আধিপত্য। বিস্তারের কোনও প্রকারের লােভ নেই। যে লজিক আমাদের সেনা পাঠাইতে বাধ্য করিয়াছে, সেই লজিকই। আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতির উপহারখানি তুলিয়া ধরিয়াছে।  এইবার রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর শােনার ও শােনবার দাবি অবশ্যই দুর্বার হইয়া উঠিবে। কাঁটা। পড়িবে এক তরফা ডিক্রির পথে । দুনিয়ার হাটে একটি বিরাট মানবগােষ্ঠীর স্বার্থ নিলামে তুলিয়া বিকাইয়া দেওয়া আর চলিবে না। ভারত আজ যেমন নির্বান্ধব নয়, তাহার সঙ্গী বাংলাদেশও তেমনই নির্বান্ধব থাকিবে। হয়তাে দ্রুত, হয়ত ধীরে ধীরে দেখা যাইবে আরও বহু শুভার্থী তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে- একে। একে স্বীকৃতির ফোটা তাহার কপালে পরাইয়া দিতে আগাইয়া আসিয়াছে অনেকেই। অতঃপর কী? স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের পক্ষে রাজনৈতিক, ভারতীয় সেনা এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সামরিক স্বীকৃতি শুরুর কথা, কিন্তু শেষ কথা নয়। শেষ কথা প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী ও দৃঢ়মূল প্রতিষ্ঠা, অধিকার ব্যাপ্ত হইলে স্বীকৃতির ঘাটতি থাকিবে না। ভারতের পর এই সিদ্ধান্তের পদাঙ্ক অনুসরণ করিবে কে, সেইটাই প্রশ্ন। প্রথম পদক্ষেপ ঘটিবে সম্ভবত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি হইতে। কিন্তু গণতন্ত্রীরাই বা নয় কেন? পূর্ব বাংলার ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা দেখাইয়া দিল, গণতন্ত্র কেবল নপুংসক এবং হাহুতাশসর্বস্ব নাও হইতে পারে।

ডেমােক্র্যাসি সাহসিক হয়, গণতান্ত্রিক আদর্শকে বাঁচানাের জন্য অস্ত্র ধারণ করিতে পারে- একালের ইতিহাসে শ্রীমতী গান্ধীই প্রথম দেখাইলেন। ভারতের কাজে সত্যকার গণতন্ত্রী দেশগুলির অতএব গর্বিত হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাঁকে পড়িয়া কোথাও গণতন্ত্র, কোথাও সমাজতন্ত্র এই সব বড় বড়াই আজ অর্থহীন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। একদিকে চরম নির্লজ্জতায় নগ্ন হইয়া । দাঁড়াইয়া আছে মার্কিন আর অন্যদিকে চীন। আগামীকাল সমাজতন্ত্র অভিমানী চীনের সম্পর্কে কী রায় দিবে? ধিক্কারের অক্ষরে এই কথা কি লেখা থাকিবে না যে “এই একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ; সে একটি উৎপীড়িত জাতির উপর বলাক্কারে সায় দিয়াছে, এক সন্ধিক্ষণে ঔপনিবেশিক অত্যাচারী প্রভূদের পাশে দাঁড়াইয়াছে।” | বাংলাদেশের আজ বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। সূর্যোদয়কে যাহারা অস্বীকার করে, তাহারা অন্ধ মাত্র, অস্বীকৃতির দৃষ্টিহীনতা সকালের রশ্মিজালকে মিথ্যা করিয়া দিতে পারে না। “জয় বাংলার যাত্রা শুরু হইয়াছে আগে, সেই পথ আজ নূতন একটি মােড় লইল, এবং এই পথও কুসুমাস্তীর্ণ নহে- রুধিরক্ত। সামনে এখনও চড়াই পড়িয়া আছে, এমন কি দেশ হইতে শেষ দখলদার সেনাটি বিদায় লইয়া গেলেও দেশের কর্ণধারদের কাজ বা পরীক্ষা ফুরাইবে না। বরং আসল পরীক্ষার সময় আসিবে তখনই। দুঃখের দিনে যে জাতি এক। হইতে পারিয়াছে, জয়ের পরেও সে যেন সেই ঐক্যকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে। সহযােগিতার নূতন যুগের ভােরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘােষিত নীতিই আরও একবার মনে পড়াইয়া দিয়াছেন ? নব রাষ্ট্রের মূল কথা হইবে গণতন্ত্র আর সমাজবাদ; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমসমাজে প্রতিষ্ঠা। তাহার পররাষ্ট্র নীতিই হইবে গােষ্ঠী নিরপেক্ষ; সে উপনিবেশিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা করিয়া চলিবে। অর্থাৎ ভারত আর বাংলাদেশ কেবল হাতেই হাত মিলায় নাই,একসূত্রে দুইটি মনকেও বাঁধিয়াছে। উভয়েরই লক্ষ্য শান্তির সুধাশ্যামলিম পার, উভয়েরই সম্মুখে সমস্যার উত্তাল পাথার।

পাকিস্তান কী করিবে না করিবে, তাহার বন্ধুরাই বা কোন্ চক্ষে সহযােগিতার এই সহযাত্রাকে দেখিবে, এই পূর্ণ মুহুর্তে সে প্রশ্ন অবান্তর । যাহা প্রত্যাশিত, পিণ্ডির জঙ্গীশাহী বাংলাদেশ সরকারের নব অভিষেকক্ষণে ঠিক তাহাই করিয়াছে, পত্রপাঠ ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বালাই চুকাইয়া দিয়াছে। বালাই চুকাইয়া দিতে দিতে জঙ্গীশাহী নিজে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়া ঠেকিবে, কোথাও তিষ্ঠিতে পারিবে তাে? তাহাদের মুখপাত্র অথবা ক্রীড়নক যে ইয়াহিয়া খান, তাঁহাকেই কি তাহারা মসনদে তিষ্ঠিতে দিবে? স্বীকৃতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশ হইতে দখলদারদের বিদায় অবশ্যম্ভাবী- আসন্ন। কিন্তু তাহার পর? এত বড় অঙ্গহানির পর অবশিষ্ট ভাগেরও অটুট থাকা শক্ত। বালুচ, সিন্ধী, পাঠান জনমত যখন মাথা চাড়া দিবে, তখন ইসলামাবাদের খানশাহী কি খাখা হইয়া ভাঙিয়া পড়িবে না?

৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা