বাংলাদেশের হৃদয় হতে
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ যে মূর্তিখানি সহসা বাহির হইয়া আসিয়াছে, সেই মাতৃভূমির দিকে তাকাইয়া কাহারও চোখের পলক পড়িতে চাহেনা। তাহার বঞ্চনার দিন শেষ হইয়াছে। তাহার লাঞ্ছনার নিশা অপগতপ্রায়। তাহার সন্তানেরা এতদিন, শত্রুর চক্ষুকে ফাকি দিয়া নিজেদের অস্তিত্বকে গােপন রাখিয়া দূরে দূরে ঘুরিয়াছেন; কিন্তু সে মূর্তিখানিকে হৃদয়পটে আঁকিয়া লইয়া তাঁহারা ঘর ছাড়িয়াছিলেন, তিলেকের তরেও সেই মূর্তিকে তাহারা অস্পষ্ট হইতে দেন নাই। বস্তুত, হৃদয়ের সেই মূর্তি যাহাতে বাহিরেও প্রতিষ্ঠা পায়, তাহারই জন্য এতদিন তাহারা বুকের রক্ত ঢালিয়াছেন। কত শহরে-শহরে, কত গ্রামে-গ্রামান্তরে কী বিপুল পরিমাণ রক্ত যে এতদিন ঝরিয়াছে, কে কাহার হিসাব দিবে। সেই হিসাবের দিনও হয়ত আজ নয়। আজ হয়ত শুধু এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করিবার দিন যে, বীরের সে রক্তস্রোত ব্যর্থ হয় নাই। পরম সত্য উপলব্ধির দিন; এবং পরম দৃশ্য, দেখিবার লগ্ন। দেশ মাতৃকার সেই ‘দরিদ্র বেশ আজ আর নাই । তাঁহার মুখের হাসিও আজ আর মলিন নয়, ‘ভাঙা ঘরের মধ্যে যিনি একলা পড়িয়াছিলেন, তাঁর ধূলাবলুণ্ঠনের দিন ফুরাইল, দিক দিগন্ত উজ্জ্বল করিয়া সেই রৌদ্রবসনার আঁচল এখন ঝুলিতেছে।
বাংলাদেশের রূপকল্পনা করিতে গেলে একটি স্নিগ্ধ, শ্যামল, নম্র, লাবণ্যের কথাই তাে সকলের মনে পড়ে। স্নিগ্ধতা তাহার নদী জলে, শ্যামলতা তাহার তৃণদলে, নম্রতা তাহার সবুজ অরণ্য আর শস্যক্ষেত্রের আত্মভােলা বিহব্বলতায়। কিন্তু সেই আপাত-আদ্র ভঙ্গির অন্তরালে যে এক বজ্রকঠিন সংকল্প নিহিত, অনেকেই তা জানে আজ জানিবার দিন; লক্ষ্য অর্জনের জন্য চরমতম মূল্য দিতেও যাহা পরাসুখ নয়, সেই কঠোর সংকল্পের চেহারাখানিকে আজ চক্ষু ভরিয়া দেখিয়া লইবার দিন। নম্রতা আর কঠোরতার, জল আর আগুনের যুগলরূপ দেখিয়া আজ আবার নূতন করিয়া বলিবার দিনঃ ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি।’ একই সঙ্গে যাহা নম্র ও দীপ্ত, কঠিন ও লাবণ্যময়, বাঙালী সংগ্রামিদের দুর্জয় আকাথার ভিতর হইতে সেই মুখশ্রী আজ সর্বজনের চোখের সম্মুখে উঠিয়া আসিয়াছে। দুঃখের অমারাত্রিকে দূরে ঠেলিয়া রৌদ্রপ্লাবিত শ্যামল ভূখণ্ডের উপরের প্রকাশ পাইয়াছে সে মূর্তিখানি, সংগ্রামিকেরা এতদিন শুধু স্বপ্নেই যাহাকে অবলােকন করিয়াছেন। স্বপ্ন আজ বাস্তবে পরিণত । লক্ষ্য আজ অর্জিত। অজ্ঞাতবাসের পালা আজ শেষ। বাংলামায়ের বীর সন্তানেরা আজ সাফল্যের, স্বার্থকতার তােরণে গিয়া দাঁড়াইয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র একদিন আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিলেন, “বাঙ্গলার ইতিহাস চাই । নহিলে বাঙালী কখনও মানুষ হইবে না। সেই ইতিহাস লেখা হইয়াছে, আরও হইবে। কিন্তু কে না জানে, কলমের বদলে তলােয়ার দিয়া এবং কালির বদলে বুকের রক্তদিয়া এক নুতন ইতিহাসও আজ লেখা হইয়া গেল। সেই নূতন ইতিহাস বস্তুত এক অতুলনীয় মনুষ্যত্বেরই ইতিহাস।
৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮