বাংলাদেশ ছাড়াে
যেন তিনটি দশক পার হইয়া সেই “কুইট ইন্ডিয়া” ঘােষণাটিরই প্রতিধ্বনী শােনা গেল। একটু অন্য অর্থে অন্য পরিপ্রেক্ষিতে। পাক জঙ্গীশাহী সত্যই যদি শান্তি চাহে, তবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ। ছাড়িতে হইবে। এই নােটিশটি রাজ্যসভায় পাঠ করিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী-ভাষ্য একেবারে দ্ব্যর্থহীন, আর কোনও হেঁয়ালি বা অস্পষ্টতা রহিল না। এক হিসাবে ইহাও একটি “পয়েন্ট অব নাে রিটার্ন।” | ঠিক এইভাবে এই ভাষায় ভারতের নীতি আগে কখনও উচ্চারিত হয় নাই। শুধু কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তার কথাই। বলিতেছি না, বিশ্লেষণ করিলে তাহার চেয়েও গভীর অনেক অনিবার্য তাৎপর্য চোখে পড়িবে। প্রথমত আমাদের আগেকার প্রতিবাদ ছিল সীমান্তে পাক সৈন্য সমাবেশের বিরুদ্ধে। আজ শ্রীমতী গান্ধী বলিতেছেন। গােটা বাংলাদেশই দখলদার ফৌজমুক্ত হওয়া চাই। ওই ভূভাগে তাহাদের অবস্থিতি ভারতের নিরাপত্তার। পক্ষে বিপজ্জনক। ইতিপূর্বে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে শুধু শুভেচ্ছার কথাই বলা হইত। বােধহয় এই প্রথম “সমর্থন” শব্দটিও শােনা গেল । শব্দটির বহুরূপ ব্যাখ্যা সম্ভব। কিছুদিন আগে অবধি আমাদের নিজস্ব ভাবনা। ছিল অগনন এবং ক্রমস্ফীত শরণার্থীদের সংখ্যা লইয়া । মানবিক দায় অর্থনীতিক দায়ও হইয়া উঠিয়াছিল, এবং নিজের স্বাস্থ্য ও স্বার্থের জন্যই আমাদের চক্ষে ও পক্ষে শরণার্থী-সমস্যার সমাধান হইয়া উঠিয়াছিল। জরুরী। শরণার্থীদের উৎখাত করিয়া ভারতে প্রেরণ- সেটা এদেশের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়াশাহীর প্রকারান্তরে। আগ্রাসন। সােজা ভাষায় বাড়ি চড়াও হওয়া। এবার শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশে যথেচ্ছ গণহত্যার ট্র্যাজেডির কথাও তারস্বরে উথাপন করিয়াছেন। ওদেশে ছিন্নমুল মানুষ আজ তাড়া খাইয়া গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ঘুরিয়া বেড়ায়, স্থায়ী ঠাই কোথাও নাই । প্রতিবেশী অঞ্চলের মানবগােষ্ঠীর উৎসাদন আমরা বরদাস্ত করিতে পারিনা, যেহেতু ওখানকার নিরস্ত্র নরনারী ধ্বংস হইলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাও বিপন্ন। প্রধানমন্ত্রী এই দৃষ্টিভঙ্গী হইতে জঙ্গীশাহীর অনাচারকে বিচার করিয়াছেন, এবং এই একটি কথায় বাংলাদেশের আর ভারতের স্বার্থ এক হইয়া মিশিয়া গিয়াছে।
ঠিক এইভাবে আগে ব্যাপারটাকে দেখা হয় নাই। বাংলাদেশের লক্ষ্য কী? আগে শ্রীমতী গান্ধী শুধু এইটুকু বলিয়াছেন, সেটা বাংলাদেশের জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদেরই বিচার্য ঃ এবার আর একটু অগ্রসর হইয়া তিনি বলিলেন যে, স্বাধীনতার কমে কিছুতে বাংলাদেশ সম্মত হইবে না, ইহাই তার ধারণা। গােটা এলাকা হইতে সৈন্য অপসারণের শর্ত এই স্বাধীন বাংলাদেশ সত্তার পরােক্ষ স্বীকৃতি বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায়। এবং সেইহেতুই বিস্ময়কর বা চমকপ্রদ ঠেকে – নতুবা আন্তর্জাতিক হিসাবে বাংলাদেশও এখনও পাক রাষ্ট্রের অঙ্গ। | প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের প্রত্যক্ষ লক্ষ্য ইয়াহিয়া খান, কিন্তু তাহার আসল বক্তব্য সম্ভবত ওই আন্তর্জাতিক আসরের উদ্দেশেই। পাক শাসকচক্র আর বাংলাদেশে মােতায়েন পাক সেনা এই দুইভাগকে তিনি আলাদা। করিয়া দেখিয়াছেন। সৈন্যরা লড়িতেছে পেটের দায়ে, নিজ নিজ ঘরবাড়ি হইতে হাজার হাজার মাইল দূরে কিন্তু কীসের জন্য তাহারা জানে না। তাহাদের বিচ্ছিন্নতা এবং বিপত্তির কথাও শ্রীমতী গান্ধী উল্লেখ করিয়াছেন, জঙ্গী নায়কেরা আর হুকুমদার দখলদার পাক ফৌজ যেমন এক নহে, তেমনই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিও তাহার দৃষ্টিতেই আজ আর এক নহে। | আন্তর্জাতিক আসর, বিশেষ করিয়া “নিক্সন অ্যান্ড কোংকে” এই কথাগুলি বলার প্রয়ােজন ছিল। নিক্সন সাহেব নাকি বড়ই গােসা করিয়াছেন। একটি জাতির দলন যিনি ঠেকাইতে পারেন নাই, একটি জাতির মহানায়ককে যিনি আজও মুক্ত করাইতে পারেন নাই। তিনি ভারতের আত্মরক্ষার আয়ােজন, প্রয়ােজন ও ব্যবস্থা হঠাৎ গােস্সা করার গোসাই হইয়া উঠিলেন কেন সে এক বিস্ময়। বােধহয় চীনে যাওয়ার এবং মাওয়ের সঙ্গে মােলাকাত করার আকুলতায় অস্থির হইয়া । (হঠাৎ, কে জানে, কী লক্ষণ দেখিয়া, এখানে। সেদিন যাহারা “ইন্দিরা-ইয়াহিয়া এক হ্যায়” এই সস্তা খিস্তি ছড়াইয়াছিল তাহারা এখন কোথায়? কই “নিক্সন চৌ এক হ্যায়” এমন কোনও শ্লোগান তাে কাহারও মুখে ফোটে নাই।) তবে শ্রীমতী গান্ধী নিক্সন সাহেবের রাগকে পরােয়া করেন নাই। আবার আগামী কালের জন্য কোনও অলীক আকাশকুসুমও রচনা করেন নাই। স্পষ্ট বলিয়াছেন, আমাদের এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে আগামী মাস খুব কঠিন মাস।
চ্যালেঞ্জের মােকাবিলায় সকলকে সজ্জবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাইয়াছেন। পাকিস্তান একটা অসম্ভব লড়াইয়ে লেজেগােবরে হইয়া আছে ইহা ঠিক; মুক্ত অঞ্চলের পরে মুক্ত অঞ্চল, মুক্তি বাহিনীর সাফল্য এবং পাক এয়ার লাইনসে অসামরিক সব চলাচল একেবারে বাতিল করিয়া দেওয়া পিণ্ডিশাহীর কোনঠাসা দশার লক্ষণ তবু মনে রাখিতে হইবে, পাকিস্তানের বিস্তর দোসর আছে, চীন তাহাকে দেদার হাতিয়ার জোগাইয়া যাইতেছে। পিছনে খাড়া আছেন তাহার স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ সপারিষদ প্রেসিডেন্ট নিক্সন। পাকিস্তান যত অনায়াসে আমাদের এলাকায় গােলাগুলি ঢালিতে পারে, আমরা তাহা পারি না, যেহেতু সীমান্তের ওপারের অসামরিক মানুষ ও ক্ষেত খামারগুলির কথাও ভাবিতে হয়। প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়ােজন যতটুকু, ঠিক ততটুকুই করিতে পারি- বাকিটা মুক্তি বাহিনীর ভার। উপরন্তু চাপ দেওয়ার জন্য পিণ্ডিচক্রের হাতে সবচেয়ে বড় কজা মুজিবর রহমান- তাহার প্রাণ। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবাসী বিপুল সংখ্যক বাঙালী সম্প্রদায়ের কথাও ভাবিতে হইবে। সুতরাং শ্রীমতী গান্ধীর ভাষায়, কোনও ঝটপট ম্যাজিক সম্ভব নয়। ওই কজা ছাড়া আমাদের জব্দ করার আর একটা ফিকিরও পিণ্ডিশাহী খুঁজিয়া ফিরিতেছে- রাষ্টপুঞ্জকে টানিয়া আনা আর আসরে নামানাে- আর এই ব্যাপারে দুনিয়ার অনেক চাই তাহার পাশে আছে। এসবই নিশ্চয়ই শ্রীমতী গান্ধীর হিসাবে আছে, নহিলে ঠিক ওই ভাষায় তাহার ভাষণ উচ্চারিত হইত না। এ ভাষার একমাত্র উৎস বিরাট আত্মপ্রতীতি, ইংরাজিতে যাহাকে বলে “পজিশন অব স্ট্রেংথ”, কতকটা তাই। নিক্সনের কুটিতে যিনি তুচ্ছ করিয়াছেন তিনি দরকার হইলে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপুঞ্জের ন্যাক্কারজনক পাঁয়তারা ও ভূমিকাকে উপেক্ষা করিবেন। রাষ্ট্রপুঞ্জ নহিলেও যে একটা জাতির চলে তাহা দীর্ঘকাল দেখাইয়া দিয়াছে সামরিক ভাবে বলীয়ান চীন আর বৈষয়িকভাবে বলীয়ান সুইজারল্যান্ড আসল কথা অতএব আত্মবিশ্বাস ও আত্মবল । শ্ৰীমতী গান্ধীর বিবৃতির পর আর সন্দেহমাত্র রহিল না যে ভারত আজ এই পথেরই পথিক, হয়তাে বা তাহাকে চলিতে হইবে একলাই। তাহার সহায় তাহার মনােবল, তাহার সহায় বাংলাদেশবাসী। এই উভয়েই আজ পাশাপাশি রাজনৈতিক সমাধানের সব রাস্তাই বস্তুত রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে।
২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা