জঙ্গী জমানার স্বরূপ
আর ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বলা নয়, পাক প্রেসিডেন্টের মুখে এইবার খােলাখুলি লড়াইয়ের বুলি ফুটিয়াছে । কষিয়া পেটি বাঁধিয়া তিনি হুঙ্কার ছাড়িয়াছেন “দশ দিনের মধ্যেই যুদ্ধ”, আর তিনি স্বয়ং নাকি সিপাহসালার ইয়া রণক্ষেত্রে গিয়া দাঁড়াইবেন । জঙ্গী নায়কের মুখে সমরে চলিনু, হাম্” জিগিরটা এমন কিছু অবাক ব্যাপার নয়, তবে দড়বড়ি ঘােড়া চড়ি তিনি কোথায় যাইবেন পূর্বভাগে না পশ্চিমে, সেটা খােলসা করিয়া বলেন নাই । এইটুকু বােঝা যায় যে পিণ্ডির যুদ্ধবাজ পাখিগুলি রণসাধে একেবারে অস্থির হইয়া উঠিয়াছে। সেই সাধ তাহাদের ভাল করিয়াই মিটিবে তাহাতে সন্দেহ নাই। ইতিমধ্যেই এই সাধের মাশুল দিয়াছে ও দিতেছে স্যাবার জেট এবং শাফি ট্যাংকগুলি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঠিক নয়-মাসে পড়িল। অনন্তকাল একটা অন্যায় যুদ্ধ চালানাে অসম্ভব, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়া পিঞ্জির নায়কেরা এইবার ভারতকে যুদ্ধে জড়াইয়া একটা কিনারা করিতে চায় । ‘জড়ানাে মানে এই নয় যে, তাহাদের মনে জয়লাভের কিছুমাত্র আশা আছে। এইমাত্র আশা, এই উপায়ে যদি গােটা দুনিয়াকে, বিশেষ করিয়া পাকিস্তানের মুরুব্বি ও মাতব্বরদের এই উপমহাদেশে মােড়লি করার ছুতা ঘটাইয়া দেওয়া যায়। খানশাহীর আরও আশা, তাহাতে নাককান কাটা যাক, অন্তত মুখটাতাে বাচিবে। এই মুখ বাঁচানাের চক্রান্তই চলিয়াছে পিণ্ডি লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকা যায় কিনা, তাহা লইয়া শলাপরামর্শ চলিয়াছে। উদ্দেশ্য একটাই- বাদী আর বিবাদীকে একই কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে। আর সেই আসরে কথার কচকচি এবং হিতােপদেশের ফোয়ারা ছুটাইবে সেই রাষ্ট্রগুলিই, যাহারা বরাবর বিশ্বজোড়া স্বার্থ আর প্রভূত্বর ফাদ পাতিয়া রাখিয়াছে। নির্লজ্জতা ইহার চেয়ে নিরাবরণ হইতে পারে না। পাক মুরুব্বিদের আর একটা মতলব, যেনতেন প্রকারেণ বাংলাদেশ নামে স্বাধীন একটি জাতির অ্যুদয়কে ঠেকাইয়া রাখা আর বাংলাদেশের জনগণের উপর অকথ্য অত্যাচার আর উৎপীড়নের কলঙ্কিত কাহিনীটাকে একেবারে ধামা চাপা দেওয়া। সবই পেয়ারের পিণ্ডির ঔপনিবেশিক স্বার্থে। সেটাও এমন কিছু বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। ঔপনিবেশিক শােষণের কল্যাণে যে-সব জাতি পুষ্ট হইয়াছে, স্বদেশে তাহারা যতই গণতন্ত্রী হউক, আসলে ঔপনিবেশিক দখলদারির মধ্যে এমন কিছু অন্যায় অনাচার দেখিতে পায় না। চিতা বাঘের ডােরা কি কখনও বদলায়? না।
তবু এত যে মদত, এত যে চক্রান্ত, শেষ পর্যন্ত তাহা দিয়াও সাধের পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করা চলিবে কি? সাম্রাজ্যবাদী যােগসাজসে অমােঘ বিধানে তাহার জোড়াগুলি একে একে খসিয়া পড়িয়াছে। নিছক ধর্ম যে একটা জাতির জন্ম দিতে পারে না, তাহার প্রথম এবং প্রত্যক্ষ নমুনা দেখাইয়া দিয়াছে বাংলাদেশ; পরে সেই একই বিভেদের লক্ষণগুলি পশ্চিম পাকিস্তানেরও রাষ্ট্র-অঙ্গে দূষিত পারার মতাে ফুটিয়া বাহির হইতেছে। পূর্ব খণ্ডে যখন বালুচ আর পাঠান সেনাদের সামনে রাখিয়া পিণ্ডির নায়কেরা তাহাদের জবরদখল বজায় রাখিতে চাহিতেছে, নিয়তির কী কুরু পরিহাস, ঠিক তখনই কিনা পশ্চিম ভাগে পাঠান আর বালুচ জনমতকে আর বাগে রাখা যাইতেছে না। গেলে পাকিস্তানে ওই প্রান্তে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে দমন এবং পার্টির নেতাদের ধরপাকড়ের দরকার হইত না। এই একটা আচরণে দূরাচারী ইয়াহিয়াশাহীর নগ্নস্বরূপ আরও একবার তাহার হাড়চামড়াসুদ্ধ বাহির হইয়া পড়িল। আরও একবার প্রমাণ মিলিল যে, স্বৈরাচার তাহার সামান্যতম সমালােচনাও সহ্য করে না। বালুচ ও পাঠান জনমনের উপর ন্যাপ-এর প্রভাব বিলক্ষণ- গতবারের নির্বাচনই তাহার সাক্ষী হইয়া। রহিয়াছে। জন প্রতিনিধিদের সব দাবিকে উড়াইয়া দিয়া এইভাবেই জঙ্গীজমানা তাহার দাপটের ঝাণ্ডা উড়াইয়া রাখিতে চায়। এখনও বাকি রহিলেন জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো। তিনি এখনও গোঁফে তা দিতেছেন, আশায় আশায় আছেন, ধূর্ত মার্জারের মতাে ভাবিতেছেন, শিকা ছিড়িয়া পড়িল বলিয়া। কিন্তু বেচারী ভুট্টো সাহেব। তাহারও না মিটিবে সাধ, না পুরিবে আশা । জঙ্গীতন্ত্রকে বৃথাই তিনি ভজনা করিয়া চলিয়াছেন। তাহার ভিতরের হৃদয়কে এখনও চিনিয়া উঠিতে পারেন নাই। জঙ্গী জামানা মতলব হাসিল করার জন্য কখনও কখনও কাহাকেও হাতে রাখে, গণতন্ত্র ফিরাইয়া “দিচ্ছি, দেব” বলিয়া স্তোক দেয়, কিন্তু গণতন্ত্র কোনও দিন ফিরাইয়া দেয় না। পিণ্ডির খানখানানগণ আপাতত ভুট্টো সাহেবকে ঝুলাইয়া রাখিয়াছে আশার জালে, পরে যে কোথায় কীভাবে ঝুলাইবে কেহ বলিতে পারে না; অতএব খুঁটেদের পােড়া দেখিয়া গােবরভুট্টোর মুখে হাসিও সাজে না।
২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা