You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.01 | মানহারা মানবী - সংগ্রামের নোটবুক

মানহারা মানবী

একজন দুইজন নহে, বস্তুত শত শত মানহারা মানবীর মর্মজ্বালা আর্তনাদ ও দীর্ঘশ্বাস পূর্ব-বাংলার কয়েকটি কারা শিবিরের ভিতরে দিন রাত্রির মুহূর্তগুলিকে শিহরিত করিতেছে। পাকিস্তানী সেনা ও তাহাদের অফিসারেরা যাহারা ইয়াহিয়ার বরে পিশাচের প্রাণ পাইয়াছে, তাহাদের লালসার উৎপীড়ন সহ্য করিতেছে এইসব কারাশিবিরের বন্দিনী নারী। মানহারা মানবীদের দুর্ভাগ্যের বার্তা বিদেশী সাংবাদিকরাও প্রচার করিয়াছেন। কারা শিবিরের চারিদিকে বাধার আবরণ ভেদ করিয়া দুর্ভাগিনীদের যন্ত্রণাক্ত অদৃষ্টের কিছু কিছু করুণ তথ্য বাহিরে আসিতে পারিয়াছে বটে, কিন্তু দুর্ভাগিনীদের জীবন সেই নিদারুণ বন্দিনী দশা হইতে উদ্ধার পাইবার সুযােগ পায় নাই। আওয়ামী লীগের জনৈক নেতা বলিয়াছেনঃ ঢাকা চট্টগ্রাম ও ননায়াখালির তিনটি শিবিরে প্রায় পাঁচশত বাঙালী যুবতীকে বন্দী করিয়া রাখা হইয়াছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিশ্বের নেতৃবৃন্দের কাছে ইহাদের উদ্ধারের জন্য আবেদন জানাইয়াছেন। বিশ্বের বড় বড় সভ্য জাতি, যাহারা সভ্যতা ও মানবতার নীতি এবং আদর্শের সুরক্ষার জন্য অজস্র আকুলতা প্রদর্শন করিয়া থাকে, তাহারা যে পাকিস্তানী সামরিকের এই নিদারুণ নারকীয় আচরণের কোন সংবাদ এতদিনের মধ্যে পায় নাই, তাহা নহে। কিন্তু কেহই এ বিষয়ে উচ্চস্বরে একটি ভ€সনার কিংবা প্রতিবাদের কথাও পাকিস্তানকে বলে নাই।  প্রশ্ন হইল, বিশ্বের বিভিন্ন সভ্য দেশের নারী-সমাজই বা কেন নীরব রহিয়াছেন? উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনৈক ব্রিটিশ সামরিক অফিসারের কন্যা মিস এলিসকে যখন উপজাতীয় আফ্রিদিরা অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছিল, তখন ব্রিটেনের নারী সমাজের শত শত জনসভায় প্রচণ্ড প্রতিবাদ গর্জিত হইয়াছিল, প্রতিশােধ দাবি করা হইয়াছিল। এর ব্রিটিশ সেনা বহু উপজাতীয় গ্রাম পুড়াইয়া বহু আফ্রিদিকে হত্যা করিয়া অবশেষে মিস এলিসকে উদ্ধার করিয়াছিল। দেখিয়া আশ্চর্য হইতে হয়, পূর্ব-বাংলার শত শত নারীকে পাকিস্তানী পিশাচের লালসার ভােজ্য হইতে দেখিয়াও সভ্য জাতির নারীদিগের কণ্ঠে প্রতিবাদ ধ্বনিত হইতেছে না। ইহা বিশ্ববিবেক নামে আখ্যাত বস্তুটির চরম দুরবস্থার প্রমাণ। 

কেহ মাতা, কেহ কন্যা, কেহ বধূ। অনেকেই শিক্ষিতা, অনেকে আবার নিরক্ষর কৃষকের ঘরের নারী; পাকিস্তানী পিশাচ সৈনিকেরা কাহাকেও ছাড়িয়া দেয় নাই। হােস্টেল হইতে, শহরের গৃহ ও গ্রামের কুটীর হইতে, শত শত যুবতী নারীকে লইয়া গিয়া এইসব কারাশিবিরে রাখা হইয়াছে। শুধু পূর্ববাংলার মানুষের পক্ষে নহে, মনুষ্যত্ব বিকৃত হয় নাই এমন প্রত্যেকটি মানুষের পক্ষে আজ ক্ষমাহীন আক্রোশ লইয়া মানহারা মানবীর এই দুর্ভাগ্যের প্রতিকার সন্ধান করিতে হইবে। বিশ্বের বড় বড় জাতির বড় বড় নেতাকে মনুষ্যত্বের দোহাই দিয়া অনুরােধ করিতে পারা যায়, পূর্ব-বাংলার কয়েকটি শহরের কারা শিবিরে অসহায় নারীকে বন্দিনী করিয়া এবং নারীত্বের মর্যাদা ধর্ষিত করিয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র যে অপরাধ করিয়াছে ও করিতেছে, তাহার ক্ষমা হইতে পারে না। পাকিস্তানী সৈনিকের এই পৈশাচিকতা বস্তুত পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রেরই অপরাধ, যাহার ভাগ্যবিধাতা হইল ইয়াহিয়া নামক এক অপকৃষ্ট দানব। যাহাদিগকে মানহারা মানবী বলিতে হইতেছে, তাহারা কিন্তু তাহাদের জীবনের মান হারান নাই। সরীসৃপে তাহাদিগকে দংশন করিয়াছে, এই মাত্র । বরং মনে করিতে হয়, তাঁহাদের দুঃখ যন্ত্রণা ও মর্মজ্বালা তাহাদিগকে জীবনের একটি বিশেষ গৌরবের আলােক সঞ্চারিত করিয়াছে। জাতির মুক্তির এই সংগ্রামময় ঘটনার মধ্যে তাহারা দুঃসহ দুঃখের আঘাত সহ্য করিয়াছেন। সমাজ সংসার গৃহ ও পরিজন তাহাদিগকে পুনরায় এবং আরও বেশী মমতা ও শ্রদ্ধা দিয়া গ্রহণ করিবে। শক্রর সার্বিক ধ্বংস এবং দেশের মুক্তি ও শুধু এই দুইটি ঘটনা সত্য হইয়া উঠিলেই যাজ্ঞসেনী আবার তাহার বেণী বাঁধিবেন।

১ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা