বাতাসে বারুদের গন্ধ
ধূম দেখিয়া যদি ধরিয়া লওয়া যায় পর্বত বহ্নিমান, তবে বাতাসে আজ বারুদের এই যে গন্ধ এ কীসের ইঙ্গিত?- আসন্ন যুদ্ধের পশ্চিম সীমান্তে শােনা যায় দুই সেনাবাহিনী মুখােমুখি। পূর্ব প্রান্তেও লড়াই শুধু মুক্তিবাহিনী আর পাকিস্তানী হানাদারদের মধ্যে আবদ্ধ নাই, পাক গােলায় ভারতীয় জওয়ান এবং সাধারণ মানুষেরও প্রাণ যাইতেছে। এসব সরকারি ভাবে স্বীকৃত । এই উপমহাদেশের, নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষায়, এখন নাকি “যুদ্ধাবস্থা”। সংশয় তাহা লইয়া নহে, সংশয় দুনিয়ার তথাকথিত মােড়লদের হঠাৎ মাথাব্যথার চেঁচানি শুনিয়া। একদিন নয়, দুইদিন নয়, পাক্কা সাত মাস ইয়াহিয়া শাহী বাংলাদেশে বর্বরতার জগদ্দল চালাইয়াছে, সকাল হইতে বিকাল, বিকাল হইতে আবার সকাল অবধি নিরন্তর শরণার্থী স্রোত বহিয়া এই বাংলার মাটি ভাসিয়া গিয়াছে, তবু কাহারও ঘুম ভাঙে নাই, মাথাব্যথার জন্য শান্তি আর সান্ত্বনার সারিডনের খোঁজ পড়িয়াছে আজ। আগে সকলেই ভিখারি বিদায়ের কায়দায় যৎকিঞ্চিৎ চাদা ছুঁড়িয়া দিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া ভাবিয়াছেন, ব্যস, কর্তব্য শেষ। এখন হঠাৎ “থামাে থামাে” রব। আমেরিকা ভারতকে থামিতে বলিয়াছে, এ ব্যাপারে নাকি সে নাকি ব্রিটেন, ফ্রান্স, আর রাশিয়াকে দলে টানতে চায়। পাঁচ মাথা এক হইলেই একটা পঞ্চায়েতী ফতােয়া জারি করা ঠেকায় কে? অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানকেও নাকি ঠাণ্ডা থাকিতে বলা হইতেছে; হিতৈষীরা ইয়াহিয়ার মাথায় আইসব্যাগ চাপিয়া বলিতেছে “অত চটিতে নাই। সবুর, সবুর। “উদ্বিগ্ন উথান্ট ভারত আর পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের ডাকিয়া নানা হিতােপদেশ বিলাইয়াছেন। অর্থাৎ সবটা মিলাইয়া সেই পুরাতন প্যারিটির খেলা-ন্যায় বিচারকদের চোখে ভারত আর পাকিস্তান এক। আমরা ধৈর্যের জন্য প্রশংসা পাইয়াছি, আর পাকিস্তান পাইয়াছে হাতিয়ার। কথাটা প্রধানমন্ত্রীর। এই উক্তিতে যে খেদ তাহারই প্রতিধ্বনি শােনা গিয়াছে ওয়াশিংটনে এবং দিল্লীতে। ভারত যেন সংযত থাকে, মার্কিন সরকারের এই অনুরােধে ওয়াশিংটনে ভারতের প্রতিনিধি সাফ জানাইয়া দিয়াছেন, এ অনুরােধ রাখার সময় বহিয়া গিয়াছে। তিনি প্রশ্ন করিয়াছেন মার্কিন সীমান্তে কেহ যদি ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করিত এবং কোটি খানেক শরণার্থী ধাক্কা দিয়া ভিতরে ঠেলিয়া দিত, তাহা হইলে মার্কিন ধৈর্য টিকিত কতক্ষণ? ব্রিটেনে বা আমেরিকায় দশ বিশজন বিদেশি নাগরিক ঠাই নিলেই সাড়া পড়িয়া যায়, তাহাদের ঠেকানাের জন্য কত কেতা, কত কানুন, আর ভারতে সাত মাসে ৯০ লক্ষাধিক আগন্তক।
তবু তাজ্জব ব্যাপার এই, আর এমনই সুবিচার যে, ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে ফরমান করা হইতেছে ভারতকেই। সততার এই অগ্নিপরীক্ষার আহ্বানের অপমানে আর কাজ নাই, ভারত সাধিয়া ত্রেতাযুগের সীতা হইবে না। দিল্লির প্রতিক্রিয়া সুতরাং কিছুটা কড়াই হইয়াছে। আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলিয়াছেনসৈন্য থাকিবে। যতদিন শরণার্থী আছে, যতদিন বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসা না হইতেছে, ততদিন সৈন্যও আছে। মুখপাত্র ওইখানেই থামেন নাই, জানাইয়া দিয়াছেন, আন্তর্জাতিক দুনিয়া যদি কর্তব্য পালন না করে, তবে ভারত যাহা করণীয় তাহাই করিবে- নৈতিক কোনও ভাবাবেগে নয়, করিবে জাতীয় স্বার্থে। কেননী এই সমস্যার সঙ্গে তাহার নিজের ভালমন্দ, অর্থনৈতিক স্বস্তি ও অস্তিত্ব জড়াইয়া গিয়াছে। বাহিরের ফেঁাপরদালালি এ ব্যাপারে চলিবে না। আন্তর্জাতিক আসর তথা রাষ্ট্রপুঞ্জের ন্যাকামি আর নপুংসকত্ব বাংলাদেশের ব্যাপারে যেমন বেআব্রু হইয়া পড়িয়াছে, আগে বােধহয় তেমন হয় নাই । অক্ষমতার চেয়ে অনিচ্ছাটাই এক্ষেত্রে বেশি ভয়াবহ, নপুংসকত্বের চেয়ে ন্যাকামিটাই বেশি ভণ্ডামি। আর যেখানেই হােক, এই সমস্যার সমাধান অন্তত আন্তর্জাতিক আসরে হইবে না। সম্ভাবিত যুদ্ধ ঠেকানাের জন্য যাঁহাদের এত আকুলি-বিকুলি, যুদ্ধের কারণগুলি সম্পর্কে তাহারা কিন্তু নির্বাক, নির্বিকার, চমৎকার, চমৎকার। এ যেন গােড়া কাটিয়া আগায় জল ঢালা। সেটা যে পথ নয়, ভারত সে কথা বারবার জানাইয়া দিয়াছে। রাজনৈতিক সমস্যার মানে যে কোনও গোঁজামিল নয়, সে কথা বলিয়া দিতে বাকি রাখে নাই। মীমাংসার প্রথম শর্ত মুজিবের মুক্তি, মীমাংসার প্রধান শর্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মতি। শান্তির এই সােজা রাস্তাটা ইয়াহিয়া খানশাহীর চোখে পড়ে না, মুরুব্বি মােড়লদেরও চোখে পড়ে কিনা সন্দেহ। বারবার পাকিস্তান আর ভারতকে এক কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে সেই সাবেকী। মামলাবাজি আর মামদোবাজি। ফরিয়াদী আর আসামীকে এক সঙ্গে জেরা করিয়া আসামীকেই আসকারা দেওয়া। কিন্তু ১৯৬৫, আর ১৯৭১ এক নহে। তাসখন্দ মার্কা বটিকা ভারত দ্বিতীয়বার গিলিতে রাজী নহে, সেবারের বৈদ্য এবার বােধ হয় তেমন ব্যবস্থা পত্র দিবেনও না। ভারত এইবার নিজের ঔষধ নিজেই খুঁজিতেছে, “আদার মীন”- অন্য উপায়ের কথা শােনা গেল ঠিক একুশ বছর পরে। যুদ্ধ এদেশ চায় না, কিন্তু শত্রুরা এদেশকে তিষ্ঠিতেও দিতেছে না। সুতরাং যুদ্ধ যদি আসিয়া পড়েই, তবে ভারতকেও বুঝাইয়া দিতে হইবে যে, সে তৈয়ার। আঘাতের প্রত্যুত্তরে উঠিয়া আসিবে সংঘাত। সেই সংগ্রাম। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তাে বটেই, সেই সংগ্রাম এক অর্থে তাহার নিজের স্বাধীনতা রক্ষারও সংগ্রাম।
২২ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা