You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.06 | ব্রিটিশ শ্রমিক দল এবং বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

ব্রিটিশ শ্রমিক দল এবং বাংলাদেশ

রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে যখন বাংলাদেশকে লইয়া রকমারি কূটনৈতিক খেলা, ব্রাইটনে সমবেত ব্রিটিশ শ্রমিক দল নাকি তখন ঐতিহাসিক এই আন্তর্জাতিক ঘটনা সম্পর্কে খােলাখুলি কথা বলিতে চলিয়াছেন। বক্তব্য তৈয়ারী, খসড়া প্রস্তাব এখন শুধু জাতীয় সাধারণ সম্মেলনে অনুমােদনের অপেক্ষা। তাহার পর এই প্রস্তাব আর প্রস্তাব মাত্র নয়, ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বক্তব্য। এমন একটি দলের বক্তব্য যেদল গতকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, এবং আগামী কাল হয়তাে আবার গদিয়ান হইবে। সুতরাং শুধু জামতের নিরিখ হিসাবে নয়, অন্যদিক হইতেও ব্রিটিশ শ্রমিক দলের এই প্রস্তাব অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ।  জাতীয় কার্যনির্বাহক কমিটির খসড়াটির প্রথম বৈশিষ্ট্য বােধ হয় এই যে, বয়ানে এটি সম্পূর্ণ অ-ব্রিটিশ। ইংরাজের খ্যাতি মিতভাষণের জন্য। কূটনৈতিকক্ষেত্রে যেমন তাহারা দক্ষ ঠিক তেমনই কুট-ভাষণেও নাকি তাহারা অতিশয় পারঙ্গম। ব্রাইটন প্রস্তাব তাহার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম, শ্রমিক দল স্পষ্টবাদী এবং রীতিমত উচ্চকণ্ঠ। আর সকলে যখন ‘রাজনৈতিক মীমাংসার’ নামে ধূম উদিারণে সচেষ্ট, শ্রমিক দল তখন সরাসরি জানাইয়া দিয়াছে রাজনৈতিক মীমাংসা” বলিতে তাহারা কী বােঝেন। সাধারণ পরিষদে স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউমের মত তাহারা ঢাক ঢাক গুড় গুড় কিছু শােনান নাই । তাহাদের দাবিঃ (১) বাংলাদেশ হইতে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীকে সরিয়া আসিতে হইবে, (২) ব্রিটেন এবং অন্য সভ্য দেশগুলিকে গণহত্যার দায়ে পাকিস্তানকে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাঠগড়ায় দাঁড় করাইতে হইবে, (৩) ব্রিটেন এবং পাকবান্ধব সমিতির কেহ যাহাতে পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য না দেয় সে ব্যবস্থা করিতে হইবে, (৪) আমেরিকাকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করার জন্য চাপ দিতে হইবে, এবং (৫) বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানাইতে হইবে। রাজনৈতিক মীমাংসার। সূত্র সন্ধানের জন্য প্রস্তাবে রাষ্ট্রপুঞ্জকে আহ্বান জানানাে হইয়াছে। তাহার পূর্বশর্ত হিসাবে শ্রমিক দলের দাবিপূর্ব বাংলায় নিগ্রহের অবসান এবং মুজিবরের মুক্তি। প্রস্তাবটি হুবহু অনুমােদিত হইলে এই সত্য ঘােষিত হইবে যে, ব্রিটিশ শ্রমিক দল পাকিস্তান বিভাগে সম্মত। বাংলাদেশ তাঁহাদের মতে স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। 

সেদিক হইতে এই প্রস্তাব যে শুধু ব্রিটিশ সরকারি নীতিরই বিরােধী তাহা নহে, শ্রমিক দলের প্রাথমিক দ্বিধা এবং জড়তার অবসানসূচকও বটে। ইয়াহিয়া খান অবশ্য অভিযােগ করিয়াছেন বিদেশে ‘ইদানীং তাহার এক নম্বর দুশমন ব্রিটেন। হয়তাে ব্রিটিশ সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং কিছু রাজনৈতিক নেতার কার্যাবলি তাহাকে বেসামাল করিয়া থাকিবে। এ পর্যন্ত কিন্তু এমন কোনও লক্ষণ দেখা যায় নাই যাহাতে মনে হইতে পারে সরকারিভাবে ব্রিটেন ঘােরতর ইয়াহিয়া-বিরােধী। যদিও ইউরােপের কোনও কোনও দেশের এখনও ধারণা এই যে, ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে ব্রিটেনই সঠিক নীতি নির্ধারণে হকদার, তবু সত্য এই, ব্রিটিশ সরকারি নীতি কার্যত আমেরিকার অনুসারী। হিউম সাহেব এ ব্যাপারে রজার্স সাহেবকে এড়াইয়া চলেন সাধ্য কী। লক্ষণীয় ব্যাপার এই, শ্রমিক দলও আন্তর্জাতিক বিষয়ে খুব কম ক্ষেত্রেই সরকারি নীতির বিরােধী। বাংলাদেশ উপলক্ষে ডগলাস মান; পিটার শাের বা এফ ইভানস্-এর মত কিছু কিছু শ্রমিক দলের এম-পিবাংলাদেশের ঐতিহাসিক উত্থানকে যেভাবে বুঝিবার এবং বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন তাহা অবশ্যই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণীয়। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে সকলের মধ্যে এই ‘ধর্মযােদ্ধার ভঙ্গীটি দেখা যায় নাই। পার্লামেন্টারী লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডগলাস হাউটন পাকিস্তান না ভাঙিয়াই বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসা খুঁজিতে চাহিয়াছিলেন। আর্থার বটমলিরও ইহাই ছিল মনের কথা। প্রস্তাবে ইহারা বােধ হয় একঘরে হইলেন, অথবা বাস্তবকে স্বীকার করিয়া মানিয়া লইলেন- পাকিস্তান দুই। 

ব্রিটিশ শ্রমিক দলের এই মত পরিবর্তনের পিছনে হয়তাে কিছু কিছু স্থানীয় কারণও আছে। প্রথমত, শ্রমিক দল বিরােধী ভূমিকায়। শুধু ই-সি-এম কেন, সরকারকে পিটাইবার পক্ষে বাংলাদেশও একখানা চমৎকার ছড়ি। শ্রমিক দলের সদস্যদের উদ্যোগে পার্লামেন্টে ইতিপূর্বে এ-ব্যাপারে প্রস্তাব উঠিয়াছিল। ছয় শত তিরিশ এম-পির মধ্যে প্রায় তিনশত বাংলাদেশের পক্ষে সাড়া দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ জনমত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে। জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হইয়া শ্রমিক দল তাহার বিরুদ্ধে যাইবে কেন? রুশ-ভারত চুক্তির পরে টোরিরা নাকি ইসলামাবাদের দিকে আরও ঝুঁকিতে পারে, শ্রমিক দল এ সময়ে বাংলাদেশকে উপলক্ষ করিয়া ভারতের দিকে হেলিবে- এটাই তাে স্বাভাবিক। আমরা একথা বলি না ব্রিটিশ শ্রমিক দলের কাছে আদর্শবাদ বলিয়া কিছু নাই, তাঁহাদের সব সিদ্ধান্তই দলীয় অথবা রাজনৈতিক স্বার্থ চিন্তায় প্রভাবিত। যদিও ইউরােপের ‘খাটি’ সমাজতন্ত্রী দলগুলি তাহাই বলেন, কিন্তু ভারতের পক্ষে এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে রবার্ট-ওরেন-এর আদর্শবাদের অনুসারী এই রাজনৈতিক দলে এক ধরনের যুক্তিবাদী গণতন্ত্রী আন্দোলনের সময় বহু শ্রমিক নেতা ভারতকে নৈতিক সমর্থন জানাইয়াছেন। এদেশে তাহারা এখনও “ভারতবন্ধু” বলে পরিচিত। এই শ্রমিক দলের রাজত্বেই স্বাধীনতা এবং ভারত-বিভাগ। প্রথমটির জন্য গর্বের সঙ্গে দ্বিতীয়টির জন্য পাপবােধ এখনও হয়তাে অনেক শ্রমিক দলের সদস্যকে পীড়িত করে। বাংলাদেশ বিষয়ে এই প্রস্তাব কি সে-পাপের প্রায়শ্চিত্ত। বিভাগ যে ভারতের পক্ষেও আদি পাপ, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর উপস্থিতি তাহা গত পঁচিশ বছর ধরিয়াই এই দেশকে মর্মে মর্মে জানাইয়া চলিয়াছে। মানচিত্রে ছুরি যাহারা চালাইয়াছিলেন এবার তাঁহারাও জানাইলেন পাকিস্তান ভুল। ব্রিটিশ শ্রমিক দলের দাবি- বাংলাদশের স্বীকৃতি চাই।

৬ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা