You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.29 | সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ

রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বিবৃতিটি পাঠ করিয়া শােনান, তাহাতে নাটকীয়তার লেশ মাত্র ছিল না। তাহার বক্তব্যে আন্তরিকতা যদি-বা ছিল, আগুনের আভাস নাই। অনেকের কাছে বরং শ্রীস্বর্ণ সিংহের এই বক্তৃতা কিঞ্চিৎ শীতল ঠেকিতে পারে। হয়তাে সে-কারণে ভারতের ঠাণ্ডা মাথার’ জন্য আর এক দফা প্রশংসাপত্র জুটিবে। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার এই স্বর্ণসিংয়ের এই যুক্তিপূর্ণ নরমপন্থী বক্তৃতাটি উপলক্ষেই নাকি সাধারণ পরিষদে রীতিমতাে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানী প্রতিনিধি শ্ৰী আগা শাহী বারবার তিনবার শ্রীসিংকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বিল হইলে আসরে উদিত হন সৌদি আরবের প্রতিনিধি । তাহার বক্তব্য ও পাকিস্তান যখন বেজার তখন ভারতীয় প্রতিনিধির উচিত আপসে বক্তৃতা হইতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া। সৌদি আরবের সমর্থনে অবতীর্ণ হন স্বয়ং পরিষদ সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার ডঃ আদম মালিক। তিনি বলেন- সৌদি প্রতিনিধি হক কথা বলিয়াছেন- শ্রী সিং ভাবিয়া দেখিতে পারেন। শ্রী স্বর্ণ সিংকে অবশ্য এই সব অপকৌশল নিবৃত্ত করিতে পারে নাই। তিনি তাহার বক্তব্য। পেশ করিয়াছেন। এ রকমটি যে ঘটিবে তাহা আগেই জানা ছিল। সাধারণ পরিষদের ছাব্বিশতম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচন হওয়ার পর ডঃ আদম মালিক সরাসরি জানাইয়া দিয়াছিলেন- বাংলাদেশ-প্রসঙ্গ পরিষদে উত্থাপিত হােক এটা কাম্য নয়। প্রকারান্তরে তিনি বলিতে চাহিয়াছিলেন বাংলাদেশ মূলত ভারত-পাকিস্তান বিবাদেরই আর এক রূপ। আর সৌদি আরব বা ইরান যে পাকিস্তানের সাফাই গাহিবে সেটাও কাহারও ‘অবিদিত থাকার কথা নয়। তথাকথিত যে ঐসলামি ভ্রাতৃত্ববােধ ইহাদের বাংলাদেশে পাকিস্তানের শ্মশানবন্ধুর ভূমিকায় দাঁড় করাইয়াছে, বিশ্বসভায় সেই ঐক্যবােধ যে আরও সক্রিয় হইবে সেটাই স্বাভাবিক। কেননা, এ সমর্থন আরও সহজ, মৌখিক মাত্র। গােষ্ঠী-নিরপেক্ষ দেশগুলির আডডায়ও ইহারা একই কাণ্ড করিতে চাহিয়াছে। পররাষ্ট্র সচিব শ্রী কল-এর দৃঢ়তায় মতলব পুরােপুরি হাসিল করিতে পারে নাই। শ্রীস্বর্ণসিং জানাইলেন প্রতিরােধের যত চেষ্টাই চলুক সাধারণ পরিষদেও বাংলাদেশ আলােচিত হইবে।

ভারত ভূমিকাটুকু করিয়া দিল। সাড়ে সাত কোটি নির্যাতীত বাঙালীর সমর্থনে এবার নিশ্চয় অন্য কণ্ঠস্বর শােনা যাইবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা শেষ পর্যন্ত পরিষদে কথা বলিতে পারিবেন কিনা, বলা যায় না। তবে একালের অন্যতম একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্বদরবারে অতঃপর উহা থাকিয়া যাইবে তাহা বিশ্বাস হয় না। শােনা যায়, অনেক মুসলিম রাষ্ট্রও নাকি মনে মনে এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল। এবার রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে তাহাদের আন্তরিকতারও পরীক্ষা। বাংলাদেশের মুসলমানেরা কি মুসলমান নয়? এই প্রশ্নের উত্তর বেশীদিন চাপিয়া রাখা সম্ভব নয়।  শ্রীস্বর্ণ সিং যাহা বলিয়াছেন সবই বিশ্ব-দুনিয়ার মানুষের জানা কথা। পূর্ব বাংলার ঘটনা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার এই যুক্তি বহুকাল আগেই নস্যাৎ হইয়া গিয়াছে। পাকিস্তান সরকার নিজেই অবশেষে সহায়সাহায্যের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের দুয়ারে ধর্না দিয়াছে। তাছাড়া নব্বই লক্ষ দেশছাড়া মানুষ যখন অন্য রাষ্ট্রে শরণার্থী হয় তখন সে ব্যাপারটা যে পারিবারিক পর্যায়ে থাকে না সেটাও আজ সকলেই স্বীকার করেন। শ্রী সিং দ্বিপাক্ষিক আলাপ আলােচনায় পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে আহ্বান। জানাইয়াছেন। শােনা যায়, অনেকেই গােপনে পাকিস্তানকে চাপ দিয়াছেন। কিন্তু কোনও কাজ যে হয় নাই সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই তাহার সাক্ষ্য। মুজিবরের ভাগ্য এখনও অনিশ্চিত, ঢাকায় এক তাবেদার সরকার বসানাে হইয়াছে, তা সত্ত্বেও হত্যা এবং দেশত্যাগ এখনও অব্যাহত। শরণার্থীদের ভিড় বাড়িয়াই চলিয়াছে, তাহারই মধ্যে ইয়াহিয়া খান নাকি উপনির্বাচনের চিন্তা করিতেছেন। 

এসব যে নিছক ধোঁকাবাজি শ্ৰী স্বর্ণ সিং স্পষ্ট ভাষায় তাহা জানাইয়া দিয়াছেন। তাহার কথা-শান্তির জন্য প্রয়ােজন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসা। সেই মীমাংসার পরেই শরণার্থীদের ঘরে ফেরার কথা ওঠে, তাহার আগে নয়। তথাকথিত এই “রাজনৈতিক মীমাংসা”র কথা আরও অনেক মহলেই উঠিয়াছে। বস্তুত ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টো সাহেবও এক ধরনের রাজনৈতিক মীমাংসার মায়াজাল রচনায় ব্যস্ত। তাঁহাদের তরফে “অসামরিক শাসনের জন্য আকস্মিক এই ব্যস্ততা ইঙ্গিতে বলিতেছে বহির্বিশ্বে এই গোঁজামিলের ও অনুমােদনকারী মিলিতে পারে। শ্রীস্বর্ণ সিং এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন বটে, কিন্তু সকলেই জানেন আওয়ামী লীগ আজ আর তাহাতে তুষ্ট নয়, রাজনৈতিক মীমাংসা বলিতে বাংলাদেশ সরকার আজ পূর্ণ স্বাধীনতাই বােঝেন । তাহারা সেই স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের জন্যই আজ মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত।  রাষ্ট্রপুঞ্জের ব্যর্থতার ইতিহাস যাহারা জানেন, তাঁহারা এটাও জানেন এই লড়াইয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির যৌথ ভূমিকা খুব গৌরবােজ্জ্বল নহে। যে-বিশ্বসভা ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার নীরব সাক্ষী; বিশ্বের বৃহত্তর দেশত্যাগের ঘটনায় যাহার ভূমিকা এক সাধারণ সেবা-প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি কিছু নয়, সেই সংঘ আন্তর্জাতিক রাজনীতির গার্হস্থ্যবৃদ্ধি ত্যাগ করিয়া ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াইবে এটা আশা করা বাতুলতা। বাংলাদেশকে তাহার স্বপ্নের স্বাধীনতা নিজেকেই অর্জন করিতে হইবে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সম্পর্কে ভারতের তহবিলে তিক্ত অভিজ্ঞতা যথেষ্ট । সুতরাং আশা করা যায় ভারত সরকার নিউইয়র্কের ওই কাচের প্রাসাদের দিকে তাকাইয়া বসিয়া নাই। সাধারণ পরিষদের আবহাওয়া বলিতেছে নিরাপত্তা পরিষদে না যাওয়াই সঙ্গত। সমস্যা যখন নিজেদের, মুক্তির পথ তখন নিজেদেরই খুঁজিয়া লইতে হইবে।

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা