উ থান্ট এবং বাংলাদেশ
শেষ পর্যন্ত উ থান্ট কাগজে কলমে স্বীকার করিলেন- বাংলাদেশ সমস্যা নামে একটি সমস্যার অস্তিত্ব রহিয়াছে এবং সেটি বিশ্ব-সমস্যা। রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি জেনারেল একজন জাদরেল ব্যক্তি। তাঁহাকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে পদস্থ আমলা। কিন্তু এই সম্মানের আসনটি যে মাছিমারা কেরানীর আসন মাত্র নহে, অন্তত একজন ‘আমলা’ তাহা দেখাইয়া দিয়াছেন । উ থান্ট দাগ হ্যামারশিল্ড নহেন, তৃতীয় দুনিয়ার মানুষ হইলেও প্রধান দুই শক্তির টানাপােড়নে তিনি প্রায় অস্তিত্বহীন ব্যক্তিত্বে পরিণত। বাংলাদেশ তাঁহার অসহায়তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ। গণহত্যা যখন শুরু হল উথান্ট তখন মৌন। ঐতিহাসিক সেই মৌনতার পর তােতলামি, তারপর বিহ্বল, দিভ্রান্ত নায়কের মতাে রাষ্ট্রপুঞ্জের পতাকা হাতে কিছুকাল পথে-বিপথে ঘােরাঘুরির পর অবশেষে মাননীয় সেক্রেটারি জেনারেলের মর্তে আগমন। ইতিমধ্যে কিন্তু ছয় মাস বহিয়া গিয়াছে। মুসাবিধা করিতে করিতে কিঞ্চিৎ দেরি হইয়া গেল বটে, তবু উথান্ট যে সত্যের দিকে চোখ মেলিয়া তাকাইলেন- হতভাগ্য বাংলাদেশের পক্ষে সেটাও সৌভাগ্যের কথা বইকি। | সেক্রেটারি জেনারেলের এই স্পষ্টবাদিতার পিছনে যদি কোনও রহস্য থাকে, তবে নিদ্বিধায় বলা যায়সে ওই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা রক্তের মূল্যে জানাইতে পারিয়াছে- ইয়াহিয়াকে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং তাঁহার বন্ধুবর্গ হাত ধুইবার জন্য যত সময়ই দেন না কেন, খান সাহেবের সাধ্য নাই পরিচ্ছন্ন চেহারায় বাংলাদেশ হইতে বাহির হইয়া আসেন। উ থান্টের এই বিবরণ ইঙ্গিতে বলিতেছে- বৃহৎ শক্তিবর্গের ইহাই ধারণা। পাকিস্তান সামরিক চক্রের বিজয়রথ বাংলার কাদা মাটিতে বসিয়া গিয়াছে তাহাকে আর নামানাে সম্ভব নয়। সুতরাং উ থান্ট বলিতেছেন- আপসে ফয়সালা করিয়া ফেলা দরকার। আপস? কাহার সঙ্গে? কোন শর্তে? উ থান্ট বােধ হয় জানেন না, আপসের সাধ জাগিলেও সাধ্য আজ ইয়াহিয়া খানের নাই। আপসের অধিকার এবং ক্ষমতা আজ যাহাদের হাতে তাহারা পূর্ণ স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিযুক্ত। এসব মায়াবাদী সৎপরামর্শ শােনার সময় তাঁহাদের নাই।
তবু এই শান্তি-প্রস্তাবটি তাৎপর্যপূর্ণ। ইহাতে অন্তত দুইটি ঘটনার পরােক্ষ স্বীকৃতি মিলিতেছে। প্রথমত, বাংলাদেশ এখনও অশান্ত। আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন, অর্থনীতি-বাংলাদেশের সর্ব অঙ্গনে চরম বিশৃঙ্খলা । উ থান্ট সীমান্তে সামরিক অভিযানের কথাও উদ্বেগের সঙ্গে স্বীকার করিয়াছেন। স্বাধীনতার জন্য এই সশস্ত্র লড়াই যে অবধারিত সেটা কি মার্চের ২৫-তারিখেই স্পষ্ট হইয়া যায় নাই? আর কিছুদিন এ লড়াই চলিলে যে ভিয়েনামের জটিলতা লাভ করিতে পারে পর্যবেক্ষকরা কিন্তু তাহাও জানাইয়া চলিয়াছেন। উ থান্টের এই বিবরণের একমাত্র লক্ষণীয় দিক- বাংলাদেশে পুতুল রাজ প্রতিষ্ঠা কিংবা ইয়াহিয়া খান প্রস্তাবিত অ্যামরিক সরকারকে তিনি মােটেই আমল দেন নাই। এসব গোঁজামিল যে অচল, অন্যভাবে তিনি তাহা জানাইয়া দিয়াছেন। তিনি প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার কথা পাড়িয়াছেন। সে সমাধান যে মনােমত সংবিধান আর ইচ্ছেমতাে প্রতিনিধি-মনােনয়নের মাধ্যমে সম্ভব নয়, ইয়াহিয়া খানকে সে কথা স্পষ্ট ভাবে জানানাে প্রয়ােজন। কেন না, তিনি নাকি নভেম্বরে আবার সংবিধান পেশ করিবেন।
তাহার আগে বিদ্রোহীদের শূন্য আসনে দালাল নির্বাচন তাহার মতলব। উথান্ট পাক-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে যাহা বলিয়াছেন, তাহাতে উদ্বিগ্ন অভিভাবকের সুর, কিন্তু লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর গতি কী সে বিষয় তিনি কার্যত নিপ। তবু ভারতের কপাল ভাল, এ দেশে যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। রহিয়াছেন এবং তাঁহাদের রক্ষণাবেক্ষণে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূমিকা যে নামমাত্র সে স্বীকারােক্তি মিলিয়াছে। ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক যাহাতে আরও খারাপ না হয় তাহার জন্য তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন, কিন্তু। সেই সম্পর্কে বৃহৎ প্রশ্নচিহ্ন যে শরণার্থী দল- তাহাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে তিনি মামূলী আশীর্বাদ প্রকাশ করা ছাড়া আর-কিছু বলিতে পারিলেন না। তাহার কথা-সীমান্ত এলাকায় সামরিক সংঘর্ষ শরণার্থীদের ঘরে ফেরার পথে বাধাস্বরূপ। সেক্রেটারি-জেনারেল এ দেশের শরণার্থী শিবিরগুলি একবার ঘুরিয়া গেলে পারিতেন। নানাদেশের পর্যবেক্ষকরা কিন্তু তাঁহাদের সাফ কথা শুনিয়া গিয়াছেন- তাহারা ফিরিতে রাজী একমাত্র মুজিবরের বাংলাদেশে। যে যুদ্ধকে তিনি উৎপাত বলিয়া মনে করেন, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর কাছে সে যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ই একমাত্র প্রার্থনা। কারণ, তখন তাহারা নিশ্চিন্ত মনে স্বদেশে ফিরিতে পারিবেন। সেক্রেটারি জেনারেল তাহার বিবরণে একটি তত্ত্বেরও অবতারণা করিয়াছেন। এ বিরােধ নাকি রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের মধ্যে। কিন্তু পৃথিবীর আর কোন্ রাষ্ট্রের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের দূরত্ব দেড় হাজার মাইল? সুতরাং উচিত ছিল ইয়াহিয়া খানের তথাকথিত এই অখণ্ডতারােধের মধ্যে যে ফাকি তাহাও মানিয়া লওয়া। বিশ্বের সেক্রেটারি-জেনারেল যাহাই বলুন, বিশ্ব-জনমত কিন্তু আজ একবাক্যে বলিতেছে পাকিস্তান অখণ্ড রাষ্ট্র নয়। এবং অনেকেরই অভিমত কোন দিনই তাহা ছিল না। দিল্লিতে সমবেত বিশ্বের নানা দেশের প্রতিনিধিরা যখন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য কর্মসূচী রচনা করিতেছেন উ থান্টের এই প্রাণহীন বাক্য-সর্বস্ব বিবরণ তখন সমস্যার স্বীকৃতি দিয়াই দায়মুক্ত। জনমতের দাবি কিন্তু এখন স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণ স্বীকৃতি।
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা