আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ বিশ্ব-মানুষের কাছে নূতন একটি দেশের নাম। সে দেশে মাটি আছে, মানুষ আছে, সরকার আছে, প্রতিরক্ষাবাহিনী আছে, বেতার আছে, ডাকটিকিট আছে। এমন কী বিদেশের মাটিতে একাধিক মিশনও আছে। নাই শুধু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। কেন নাই, সে এক সহজ জিজ্ঞাসা । কিন্তু উত্তরটি ভাষার জটিল। বিশেষত, এই উত্তর দেওয়ার অধিকার যাহাদের আছে, তাহাদের মুখের দিকে তাকাইলে ইহাই মনে হয়। আমরা রাষ্ট্রপুঞ্জের কথা বলিতেছি। সাধারণ পরিষদের ২৬তম সম্মেলন বসিয়াছে। যবনিকা কম্পমান। সকলের আশা বাংলাদেশ প্রসঙ্গ সেখানে উথাপিত ও আলােচিত হইবে। কেননা, ইহার সঙ্গে শুধু সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নহে, একালের ইতিহাসের নির্মমতম গণহত্যার কাহিনীও জড়িত। বাংলাদেশ হইতে আটজনের একটি প্রতিনিধিদল সে-কারণেই নিউইয়র্ক ছুটিয়াছেন। সকলের সমক্ষে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করিয়া বিশ্বসভার কাছে সুবিচার প্রার্থনাই তাহাদের বাসনা। কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলিতেছে সেটা অরণ্যরােদণে পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অনেক দেশ ইতিমধ্যেই কানে তুলা জিতে মনস্থ করিয়াছে। পরিষদের সদ্য-নির্বাচিত সভাপতিও আসনে বসিয়াই,- শীতল বারি ছিটাইতে আরম্ভ করিয়াছেন। সেটা কি ঐসলামিক কূটনীতি? নাকি স্বদেশের সামরিক নায়কদের প্রতি পরােক্ষে কুর্ণিশ? ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ মালিককে বােঝা দুঃসাধ্য নয়। তিনি যাঁহাদের আনুকূল্যে স্বদেশে সম্মানিত নায়ক- তাহাদের প্রতি দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। আর সকলেই জানেন ঐসলামিক বেরাদরির মতাে সামরিক ভ্রাতৃত্ববােধও এশিয়া-আফ্রিকার নানা দেশে বিস্তৃত। ইহারা যে নানাভাবে ক্রিয়াশীল তাহা অন্যভাবে বােঝা যাইতেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে ৭৪ টি দেশের প্রতিনিধিদের লইয়া গঠিত গােষ্ঠীনিরপেক্ষ জোটও পরিষ্কার গলায় বলিতে পারিতেছে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক মীমাংসা দরকার। বৈঠকে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সাফ কথা বার্তার পরে গােষ্ঠী-নিরপেক্ষরা অবশ্য একটু নড়িয়াছেন।
কিন্তু শেষ প্রস্তাবটি নিতান্তই গোঁজামিল। ভারতের মূল বক্তব্য চারিটি; এক, পাকিস্তানকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মীমাংসা খুঁজিতে হইবে, দুই, ভারতে আগত শরণার্থীদের উপযুক্ত পরিবেশে দেশে ফিরাইয়া লইতে হইবে এবং চার, এই সত্য মানিয়া লইতে হইবে যে, বাংলাদেশের সমস্যা পাক-ভারত সমস্যা নয়। সেক্রেটারি-জেনারেলের বিবরণে এই দাবির সার স্বীকৃত। রাজনৈতিক মীমাংসার উপর তিনিও জোর দিয়াছেন। প্রকারান্তরে জানাইয়া দিয়াছেন- আর এক মালিক ঢাকায় গদিয়ান হইয়াছেন বলিয়াই সব সমস্যা গলিয়া জল হইয়া যায় নাই। কিন্তু গােষ্ঠী নিরপেক্ষরা তবু ঝাড়িয়া কাশিবেন না। তাই বলিয়াছি আন্তর্জাতিক রাজনীতি বড়ই জটিল। সেখানে বিশাল চীনের অস্তিত্ব দশকের পর দশক উহা থাকিয়া যায়, আবার তাহাকে স্বীকৃতি জানাইবার জন্য ভূতপূর্ব প্রতিবাদীদের মধ্যেই অনুরাগের ঢল বহিয়া যায় । ঢাকার ডাঃ মালিক যখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কল্কে পাইতেছেন না, ইন্দোনেশিয়ার ডঃ মালিকও তখন নিশ্চয় সকলের মুখ আটকাইতে পারিবেন না। সাধারণ পরিষদে নানা মুখে বাংলাদেশ অবশ্যই উঠিবে। কেননা, শুধু ভারত নয়, রাশিয়া, কানাডা, জাপান, পূর্ব-ইউরােপের কোনও কোনও দেশ সমেত বাংলাদেশের নিগৃহীত মানুষের প্রতি সহানুভুতির দেশ আরও আছে। রুশ-আফগান যুক্ত বিবৃতিটিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ-প্রসঙ্গ হয়তাে এই মুহুর্তে নিরাপত্তা-পরিষদে উঠিবে না, কিন্তু সাধারণ পরিষদ ও অন্যান্য সভাকক্ষে নিশ্চয় বাংলার দুঃখ-কথা উঠিবে। সুবিচার হয় অবশ্য যদি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে সরাসরি আসরে নামিতে দেওয়া হয়। ১৯৫৮ সনে আলজিরিয়ার প্রতিনিধিদল সে-সুযােগ পাইয়াছেন। মুক্তিকামী আরও নানাদেশ এবং গােষ্ঠীও নানা সময় নিজেদের বক্তব্য পেশ করিয়াছেন। যদি কোনও ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা সে-সুযােগ হইতে বঞ্চিত হন, তবে এই ভ্রষ্টতা রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষে লজ্জা হইয়া থাকিবে। কারণ তাহা হইলে এই প্রতিষ্ঠান এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে পিঠ ফিরাইয়া বসিবে যাহা বিশ্ব-মানুষের চোখের সামনে ঘটিয়া চলিয়াছে। যাহা সূর্যোদয়ের মতােই স্পষ্ট, সর্বজনস্বীকৃত সত্য। সাধারণ পরিষদের বৈঠকের মাত্র কয় দিন আগে ভারতের রাজধানীতে একটি বিশ্ব-বৈঠক বসিয়াছিল। সেখানেও হাজির ছিলেন ২৪টি দেশের প্রতিনিধি। বৈঠকটি অবশ্য রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকের মতাে সরকারী শিলমােহরাঙ্কিত নয়, একান্তভাবেই বে-সরকারী। কিন্তু নিৰ্বিধায় বলা যায় অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক।
কেননা, যাহাকে বলে প্রকৃত জনমত তাহারই যথার্থ প্রকাশ দেখা গিয়াছে দিল্লি-সম্মেলনে। নানা দেশের সংবাদপত্রে যে সব দাবি মুখরিত, কূটনৈতিক ভাষায় যে-সব দাবির কথা কোনও কোনও সরকারের কাছেও স্বীকৃত বলিয়া কথিত দিল্লিতে তাহারই সহজ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিধ্বনি শােনা গিয়াছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতােই এই জনমতের ভিত্তি নৈতিকতায় দৃঢ়। বস্তুত রাষ্ট্রীয় আচরণে যে দ্বিধা, কপটতা, এবং স্বার্থপরতাতার বিরুদ্ধে এই অকপট ভূমিকা বিশ্বমানবতার লাঞ্ছিত পতাকাকে আবার তুলিয়া ধরিল। সম্মেলন “আন্তর্জাতিক বিগ্রেড” শেষ পর্যন্ত অবশ্য গড়ে নাই, কিন্তু তাহার কথা পাড়িয়াছে- ইহাও সামান্য কথা নহে। ওমেগা- অভিযাত্রীদের অভিযান যেমন প্রতীকী, তেমনই রীতিমতাে তাৎপর্যপূর্ণ দিল্লিসম্মেলনের কথােপকথন। বিশ্বের লুপ্তপ্রায় নৈতিকতা আবার একবার ঝিলিক দিল। কে জানে, এই সব সূত্র ধরিয়া একদিন হয়তাে রাষ্ট্রপুঞ্জের পাশাপাশি আর এক রাষ্ট্রপুঞ্জ গড়িয়া উঠিবে। একটি দরবারী, অন্যটি জনতার আদালত। এসব অবশ্য ক্ষোভের কথা। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিরুদ্ধে ক্ষোভের হেতু যে আছে, তাহাও বােধহয় অস্বীকার করার উপায় নাই। আশার কথা শুধু এই, কোনও দেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমতি লইয়া স্বাধীনতার লড়াই করে না। সে লড়াইয়ে যাহা সবচেয়ে মূল্যবান সেই গণ-সমর্থন যে ইয়াহিয়া খানের পিছনে নয়, বাংলাদেশের বীর যােদ্ধাদের পিছনে বিশ্বের মানুষ ক্রমাগত তাহা জানাইয়া চলিয়াছেন। নিউইয়র্কে কাচের মিনারে কী ঘটিল, তাহার চেয়েও বাংলাদেশের পক্ষে আজ জরুরী সমাচার- দিল্লিতে সমবেত প্রতিনিধিবৃন্দের মুখে তাহার জয়-জয়কার।
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা