শত্রুরা এখনও সক্রিয়
আবার নাশকতা। ষড়যন্ত্রীরা এবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় নাই, অভীষ্ট অনেকখানিই পূর্ণ। করিমগঞ্জের অদূরে একখানি যাত্রিবাহী ট্রেন উড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। ২৬০ মিটার রেলপথ সম্পূর্ণ ধ্বংস, যাত্রী-বােঝাই ছয়টি কামরা লাইনচ্যুত। বেশ কয়েকজন আহত, প্রাথমিক সংবাদ- একজন নিহত। নিহতের সংখ্যা অবশ্যই আরও বাড়িতে পারে। আরও উদ্বেগজনক সমাচার গাড়িটিতে সামরিকবাহিনীর লােকেরাও ছিলেন। স্পষ্টতই বােঝা যায়, ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য একাধিক। এক পরিবহন তথা যােগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করা। দুই, সামরিক বাহিনীকে বিপাকে ফেলা। শুধু এক ঢিলে দুই পাখি মারিতে চাহিয়াছিল, সম্পূর্ণ সফল না হইলেও ঢিলটি দুইকেই স্পর্শ করিয়াছে। সাময়িকভাবে ত্রিপুরার সঙ্গে রেল-যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। তাছাড়া, অন্তত একজন জওয়ান অতর্কিতে প্রাণ হারাইলেন। এই বিস্ফোরণ অতএব ফাঁকা আওয়াজ মাত্র নহে। ইহার অন্তর্নিহিত বাণীটি এখনও না ধরিতে পারিলে ভবিষ্যতে গভীরতর দুর্যোগ অনিবার্য। আসামে এটাই প্রথম নাশকতার ঘটনা নহে। বস্তুত গত জুলাই হইতে বাংলা এবং আসামে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়াই চলিয়াছে। ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ও অক্ষত নাই। তবে সবচেয়ে বেশী সংক্রমিত মনে হয় কাছাড় করিমগঞ্জ অঞ্চল। পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণের ফাকে ফাকে ওই এলাকায় চলিয়াছে নিয়মিত অন্তর্ঘাত। ইহার পিছনে কাহার হাত বুঝিতে অসুবিধা নাই। মুক্তিযােদ্ধা গেরিলার প্রত্যুত্তরে পাক-হানাদারেরা অন্তর্ঘাতে দক্ষ ভাড়াটিয়া চর-বাহিনী মাঠে নামাইয়াছে। সে সংবাদ আজ আর গােপন নাই। ইয়াহিয়ার এটা আর-এক রণনীতি। আমেরিকায় তালিম লওয়া সে সব নকল গেরিলার লীলাক্ষেত্র ছিল এককালে কাশ্মীর এখন ভারতের পূর্বাঞ্চল। শরণার্থীদের ভিড়ে মিশিয়া এই চরেরা অবশ্যই দলে দলে ভারতে ঢুকিয়াছে হয়তাে এখনও ঢুকিতেছে। কিন্তু নাশকতার প্রকৃতি বলিবে মস্তিষ্ক যাহাদেরই হােক, ক্রীড়াশীল সব কয়টি হাত। পরদেশী নহে। করিমগঞ্জের ধর্মনগর সেকশনে ট্রেন ঘায়েল হওয়ার পর কাছাকাছি গ্রাম হইতে পাক-চর ধরা হইয়াছিল। এবার যে সাত জন ধরা পড়িয়াছে তাহারা ইয়াহিয়ার সাকরেদ হইলেও জাতিপরিচয়ে নাকি ভারতীয়। এই খবর অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
পেশাদার চর দুই-চারিজন সব দেশেই হয়তাে জন্মায়। কিন্তু বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক নাশকতার কর্মসূচী বলিতেছে- এখানে জন্মাইতেছে ঝাকে ঝাকে। সকলে হাতেনাতে ইয়াহিয়ার সেবা করিতেছে এমন নাও হইতে পারে। কিন্তু তাহারা নিশ্চয় দুশমনের সঙ্গে সহযােগিতা করিতেছে। তাহা না হইলে রাশি রাশি বিধ্বংসী মাইন খুঁজিয়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই রাশি রাশি চরও ধরা পড়িত। সৈন্যবাহিনীর সতর্কতার ফলে ইতােমধ্যে একাধিক বড়রকমের বিস্ফোরণ এড়ানাে সম্ভব হইয়াছে। কিন্তু সেই সব অস্ত্র যাহারা পাতিয়াছিল তাহারা ধরা না পড়িলে বিপদ যে থাকিয়াই যায় এবারকার ঘটনা তাহা জানাইয়া গেল। সুতরাং, জরুরী প্রয়ােজন আজ চিড়িয়াদের সেই বাসাগুলি ভাঙা। সেটা শুধু সামরিকবাহিনীর কর্তব্য হইতে পারে না। এবিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব অনস্বীকার্য। বিষয়টা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্ন, স্থানীয় পুলিসের কর্তব্যের এলাকা। তাহারা ব্যর্থ হইলে অবশ্যই অন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে। প্রয়ােজন হইলে পাকিস্তানকেও জানাইয়া দিতে হইবে- ভারতে অন্তর্ঘাত চালানাের খেসারত অনেক। কিন্তু তাহার আগে প্রয়ােজন নিজের। ঘর সাফাই করা। সরাসরি জানাইয়া দেওয়ার সময় আসিয়াছে- বিভীষণ বা মীরজাফরের ঠাই এখানে নাই। দেশদ্রোহীতা পাপ। আর পাপের ‘বেতন’ যদি মৃত্যু হয় তবে ভারতীয় নাগরিক হইলেও কেহ যেন কোনও দাক্ষিণ্য ভােগ না করেন। অন্তর্ঘাতীদের শাস্তি উদাহরণমূলক হােক, এটাই কাম্য।
১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা