ত্রাণের অপেক্ষায় এই বাংলা
প্রায় চার সপ্তাহ ধরিয়া পশ্চিম বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায়। ক্ষণেকের জন্য মনে হইয়াছিল জল বুঝি এবার সরিল, কিন্তু নতুন করিয়া বন্যার আবির্ভাবে সে আশাবাদ ধুইয়া মুছিয়া গিয়াছে। প্লাবনের পরিধি দিনে দিনে বাড়িয়াই চলিয়াছে। রাজ্যের যােলটি জেলার মধ্যে এগারােটিই বন্যার কবলে, প্রায় চার হাজার বর্গ| মাইল জুড়িয়া হাহাকার। পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ আর্ত লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি নষ্ট। জমির ফসল, গােয়ালের গরুমােষ সবই জলাঞ্জলি যাইতেছে। যাইতেছে মানুষের প্রাণও। সরকারী হিসাবে—এই রাজ্যে বন্যার বলি কমপক্ষে উনত্রিশজন। এই সংখ্যা আরও বাড়িয়া চলিয়াছে। মালদহ শহর বিপন্ন। নড়বড়ে যে বাঁধটি এই শহরকে এখনও বাঁচাইয়া রাখিয়াছে সেটি ভাঙিয়া পড়িলে বিপর্যয় অনিবার্য। মৃত্যুর খতিয়ান এক লাফে বাড়িয়া যাইবে। তাছাড়া বন্যা অন্যভাবেও দক্ষিণা আদায় করে। প্লাবনের পায়ে পায়ে আসে ক্ষুধা আর মহামারী । এক কথায়, নানাভাবে বিপর্যস্ত এবং বিপন্ন রাজ্য এই মুহূর্তে চরম সংকটে। তাহার ঘরে যখন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী তখন এই রাজ্য নিজেই আজ এক সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায়। অতিথিবৎসল গৃহস্থ নিজেই আজ ত্রাণের দুর্ঘটনা কিছু ঘটিয়া গেলে বুক চাবড়াইয়া কান্না আমাদের অভ্যাস। এই বন্যা উপলক্ষেও হয়তাে চতুর্দিকে সমবেদনার বান বহিবে। কিন্তু সত্যই কি এই ধ্বংসলীলা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত? বস্তুত, বন্যা এই রাজ্যে প্রায় বার্ষিক ব্যাপার।
প্রায় প্রত্যেক বছরই রাজ্যের কোনও-না-কোনও এলাকায় বন্যা হয় এবং প্রত্যেক বছরই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়। একটি হিসাবে দেখা যায় গত তিন বছরে বন্যায় এই রাজ্যের ১৮৬ কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছে বিস্তর অর্থ। অথচ তাজ্জব ব্যাপার, এই বন্যা-নিয়ন্ত্রণের কথা উঠিলেই শােনা যায় সেই সনাতন কৈফিয়ৎ-টাকা নাই । চতুর্থ যােজনায় এই রাজ্য চাহিয়াছিল তেরাে কোটি টাকা প্রতিশ্রুতি মিলিয়াছে পাঁচ কোটি টাকার। বিধ্বংসী বন্যা ইতিমধ্যেই জানাইয়া দিয়াছে এসব হিসাবনিকাশ অর্থহীন প্রয়ােজন বন্যা নিয়ন্ত্রণের পাকা ব্যবস্থার। যে সব বালির বাঁধ’ জলের তােড়ে উড়িয়া গিয়াছে এবং যেসব বাঁধ বা খাল-না তৈয়ারি করিলেই নয়, তাহার জন্যই অবিলম্বে প্রয়ােজন কম পক্ষে ১১ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকার। কেন্দ্রীয় সেচমন্ত্রীর হাতে সে দাবিপত্রও পেশ করা হইয়াছে। সরকারকে স্থির করিতে হইবে কোনটা শ্রেয়, এই অর্থ মঞ্জুর করা না প্রতি বছর কয়েকগুণ বেশী অর্থ নগদে এবং অন্যভাবে জলাঞ্জলি দেওয়া। | কী মিলিবে কবে মিলিবে সেসব ভবিষ্যতের কথা। কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞদল আসিবেন নাকি চলতি মাসের শেষ দিকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও তখন কলিকাতায় আসিবার কথা। আমরা আশা করিব চিকিৎসার চেয়ে যে প্রতিষেধ ব্যবস্থা শ্রেয়, এবার সেই নীতি স্বীকৃতিলাভ করিবে। তাহা না হইলে এই ভাবে ক্রমাগত বাংলার রক্ত জল হইয়া নর্দমা দিয়া বহিয়া গেলে-এই রাজ্যের আর কিছুই থাকবে না। সে-ব্যবস্থা অবশ্য রাতারাতি সম্ভব নয়, একা ভাঙা বাঁধ মেরামত করিতেও অবশ্যই সময় লাগিবে। কিন্তু ত্রাণকার্যে এক মুহূর্ত বিলম্বের অর্থ। বিপন্নকে আরও বিপন্ন করিয়া তােলা। মালদহে অধিকাংশ মানুষই নিজেদের উদ্যোগে নিরাপদ এলাকায় উঠিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু অন্যদেরও সহায়তার হাত প্রসারিত করিতে হইবে। বন্যাত্রাণে ইদানীং সামরিক বাহিনী এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করিয়া আসিতেছিল। এবার সেটা হয়তাে সবক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সেকারণেই সাধারণের কর্তব্য এবার আরও জরুরী। বাংলাদেশের শরণার্থীদের লইয়া তাহারা ব্যস্ত বলিয়াই হয়তাে বন্যাত্রাণে এবার স্থানীয় ত্রাণ-সংস্থাগুলির এখনও যথেষ্ট সাড়া মিলিতেছে না। সন্দেহ নাই, সে কাজটাও জরুরী। কিন্তু মনে রাখা চাই, এই বাংলাকে বাঁচাইয়া রাখিতে না পারিলে ওই বাংলার আগন্তুকদের ভাগ্যও অগাধ জলে।
১৬ আগস্ট, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা