আঁচাইলে বিশ্বাস নাই
পাকিস্তান শেষ মুহূর্তে নুতন কোনও বায়নাক্কা যদি না তােলে তাহা হইলে ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরা। ১২ আগস্টই স্বদেশে ফিরিতে পারিবেন। ওই একই দিনে কলিকাতার পাকিস্তানী কূটনীতিকদেরও ঘরে। ফিরিয়া যাইবার কথা। তবে তাহাদের ক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন নিতান্তই কথার কথা; কেননা যাহারা একদা এ মহানগরীতে পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মী ছিলেন তাঁহাদের প্রায় সকলেই এখন ইসলামাবাদের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া বাংলাদেশের মিশনে যােগ দিয়াছেন। কাজেই যদিও আইনমতাে কূটনীতিক প্রত্যাবর্তন পর্বটা দুতরফা-পাকিস্তানী কর্মীরা পাকিস্তানে যাইবেন এবং ভারতীয় কর্মীরা ভারতবর্ষে ফিরিবেন-আসলে কিন্তু পর্বটা। একতরফা। সমস্যাটা ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদের ঘরে ফিরিয়া আসা লইয়াই। পাকিস্তান না হইয়া অন্য কোনও দেশের সঙ্গে এমন ধরনের চুক্তি হইলে উদ্বেগের বিশেষ কারণ থাকিত । ধরিয়া লওয়া যাইত এতদিন টানাহেঁচড়া চলিলেও ১২ আগস্ট ঘরের ছেলেরা নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরিয়া আসিবে-তাহাদের গায়ে আঁচড়টিও আর লাগিবে না। কিন্তু কৃপণের বাড়িতে নিমন্ত্রণ হইলে যেমন লােকে মনে করে না-আঁচাইলে বিশ্বাস নাই পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি সম্পর্কেও লােকের অনুরূপ মনােভাব।
১২ আগস্ট যখন ঢাকা হইতে সুইস ও রুশ বিমান ভারতীয় কূটনীতিক ও তাঁহাদের পরিজনবর্গকে লইয়া নয়াদিল্লি পৌছিবে তখনই লােকের প্রত্যয় হইবে পাকিস্তান তাহার কথা রাখিয়াছে-কূটনীতিক-বিনিময়-সমস্যা সমাধানের সুইস প্রতিনিধির আন্তরিক প্রচেষ্টা সার্থক হইয়াছে। ভারতীয় কূটনীতিকেরা সপরিবারে বিমানে না চড়া পর্যন্ত লােকের উৎকণ্ঠা দূর হইবে না। তাহাদের আটক করিয়া রাখিলে পাকিস্তানের কোনও লাভ অবশ্য হইবে না। বরঞ্চ দেশে দেশে তাহার। অপযশ রটিবে। কিন্তু পাকিস্তান কি তাহার জন্য পরােয়া করে, না কি বিশ্ব-জনমতের কোনও মূল্য তাহার কাছে আছে? থাকিলে ২৬ এপ্রিল ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস বন্ধ করিয়া দিয়াও তাহার কর্মীদের সে খামখা এতদিন অন্তরীণ করিয়া রাখিল কেন? কোনও দোষ তাে তাহারা করেন নাই-করিয়াছেন বলিয়া পাকিস্তান অভিযােগও করে নাই। তবুও কূটনীতিক রীতিনীতি দিব্য লক্ষ্মন করিয়া সে ভারতীয় কূটনীতিকদের অকারণ ব্রিত করিয়াছে। এমন কী বাহিরের জগতের সঙ্গে শেষ যে যােগসুত্র সেই টেলিফোনও কাটিয়া দিয়াছে। এত কাণ্ড করিতে পাকিস্তান যে ভরসা পাইয়াছে তাহার হেতু ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিকদের তুলনায় কলিকাতায় তাহার কূটনীতিকদের সংখ্যা নগন্য। আর যদি তাহাদের সংখ্যা অনেক বেশীই হইত তাহাতেই বা কী? ভারতবর্ষের কূটনৈতিক আচারে পান হইতে চুনটিও খসিবে না। যতই পাকিস্তান বেপরােয়া হউক না কেন, আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার ভারতবর্ষ কখনই লঘন করিবে না এ বিশ্বাস ইসলামাবাদের আছে। তাই ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিকদের জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিতে তাহার বাধে নাই। ভারত সরকারকেও কিল খাইয়া কিল চুরি করিতে হইয়াছে এই ভয়ে পাছে পাকিস্তান ক্ষিপ্ত হইয়া ভারতীয় কূটনীতিকদের আরও লাঞ্ছনা করে-তাহাদের দীর্ঘকাল বন্দিদশায় ঢাকায় কাটাইতে হয়। কিন্তু তাহাদের এ জ্ঞান হওয়া উচিত পাকিস্তান শিষ্টাচারকে ভীরুতা বলিয়া মনে করে। তাহার সহিত এমন ভাষায় কথাবলা উচিত, যে ভাষার সহিত তাহার পরিচয় আছে এবং সে ভাষা সৌজন্য ও ভব্যতার ভাষা নয়।
১২ আগস্ট, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা