প্রচণ্ড ঘা খেলেন ইয়াহিয়া খান
প্রচণ্ড থাপ্পর খেয়েছেন ইয়াহিয়া খান। দিয়েছেন কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের কর্মীরা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পালা সমাপ্তি। মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন সুইস প্রতিনিধি ড. বােনারড । সাক্ষী ছিলেন প্রাক্তন পাক-ডেপুটি হাইকমিশনার মাসুদ এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের অশােক রায়। পয়ষট্টিজন বাঙালী কর্মীর মধ্যে চৌষট্টিজনের কাছ থেকে মিলেছে সাফ জবাব। তারা বলেছেন—স্বেচ্ছায় তারা নিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য। কোন অবস্থাতেই ফিরবেন না পাকিস্তান। একজন আছেন ছুটিতে। তার সম্ভাব্য জবাব সম্পর্কে নেই কোন জল্পনা-কল্পনার অবকাশ। বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হােসেন আলির আচরণ প্রশংসার যােগ্য। নিঃসন্দেহে তিনি বাড়িয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা। কোন কিছুই বলার নেই ইসলামাবাদের । অনাবশ্যক জল ঘােলা করেছিলেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত এই ঘােলা পানিই খেতে হয়েছে তাদের। বাংলাদেশ। মিশনের কূটনৈতিক কর্মীরা দুনিয়ার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ইসলামাবাদ কত বড় মিথ্যাবাদী। ওদের প্রচারযন্ত্র কতখানি সত্যভ্রষ্ট। জনগণকে ধোঁকা দেবার কি সাংঘাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। | প্রাক্তন পাক-ডেপুটি হাইকমিশনের বাঙালী কর্মীদের আনুগত্যের পরিবর্তন বাইরের কোন যাদুমন্ত্রে হয় নি। ওটা ঘটিয়েছে গণহত্যাকারী পশুরা। স্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। তার ইন্ধন জুগিয়েছেন আয়ুব খান নিজে। ভারতের ছিল না কোন ভূমিকা। মানবতার খাতিরে সে দিয়েছে শরণার্থীদের আশ্রয় । জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে। শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরত পাঠাবার জন্যই তা দরকার। এই সহজ সত্য গুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। তাঁর অভিযােগ, প্রাক্তন পাক কূটনৈতিক কর্মীরা স্বেচ্ছায় করেন নি আনুগত্যের বদল। ওটা চাপান হয়েছে তাদের উপর। সত্যিকারের উস্কানীদাতা ভারত। এই মিথ্যা অভিযােগের ফলে ঢাকায় প্রাক্তন ভারতীয় মিশনের একশ ত্রিশজন কূটনৈতিক কর্মী আজ পাকজঙ্গীশাহীর গৃহবন্দী। মিশন গুটাবার পরও ফিরে আসতে পারছেন না তারা ভারতে। বর্বরদের হাতে পদে পদে হচ্ছেন লাঞ্ছিত । অপরাধী ইয়াহিয়া খান। আর তার কৃতকর্মের ফল ভােগ করছেন ঢাকার ভারতীয় কর্মীরা। কেন্দ্রীয় সরকার অহেতুক সৌজন্য দেখিয়েছিলেন ইসলামাবাদের চাই মাসুদকে। ঢাকার বর্বরতার উপযুক্ত প্রতিশােধ নেওয়া উচিত ছিল কলকাতায়। যতটুকু তারা নিয়েছিলেন তা খুবই হাল্কা। আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারের উপর যাদের আছে আস্থা তাদের সম্পর্কে পাল্টা শিষ্টাচার প্রযােজ্য। যাদের তা নেই তাদের প্রাপ্য গলাধাক্কা।
এ দাওয়াই ছাড়া কখনই সায়েস্তা করা যায় না দুর্বিনীতদের। সবার মনে জেগেছে গভীর প্রত্যাশা। ঢাকার কর্মীরা ফিরে আসবেন ভারতে। কলকাতার প্রাক্তন পাকমিশনের অবাঙালী কর্মীরা যাবেন পাকিস্তানে। এই বিনিময়ের পথে নেই কোন দৃশ্যমান বাধা। কিন্তু। শয়তানের অবতার ইসলামাবাদ। নিত্য নতুন ফ্যাকা তুলতে তারা ওস্তাদ । আবার কোন ওজর আপত্তি। আসবে কিনা বলা মুস্কিল। প্রচণ্ড চপেটাঘাতের পর অবশ্যই বন্ বন্ করছে ইয়াহিয়ার মাথা। ঠাণ্ডা হলে ওখান। থেকে হয়ত বেরুবে আর একটি শয়তানি চাল। ঢাকার কর্মীরা ফিরে না আসা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না। কোনমতেই। নয়াদিল্লির প্রয়ােজন বেশী পরিমাণ সতর্কতা। অবাঙালী সঙ্গীদল সহ মাসুদের কলিকাতা ত্যাগ। এবং ঢাকার ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীদের ভারতে প্রত্যাবর্তন ঘটাতে হবে একসঙ্গে। অন্যথায় মাসুদ এবং তার সঙ্গীরা পাবেন না স্বদেশ গমনের ছাড়পত্র। দরকার পড়লে নয়াদিল্লিকে হতে হবে আরও কঠোর । বাইরের দুনিয়া এবং বৃহৎ শক্তিগুলাে এখন কি করবে? পাক-শয়তানি এবং মিথ্যার বেসাতি ধরা পড়ার পরও কি তারা থাকবে নিষ্ক্রিয়? যাদের কথার নেই কোন দাম, সত্য গােপনে যাদের উদ্দাম আগ্রহ এবং ঘুণ্য ষড়যন্ত্রে যাদের চিরাচরিত অভ্যাস তাদের শাসনে কী ফিরে যেতে পারেন শরণার্থীরা? পাক-সুহৃদেরই বা বলার ক আছে? চোখের সামনে দেখলেন তারা বাংলাদেশ মিশনের কর্মীদের অকম্প প্রতিজ্ঞা। শতছিন্ন ইয়াহিয়া প্রচারের মুখােশ বেরিয়ে পড়া মিথ্যাচারীর নগ্ন মূর্তি। এর পরও কী তাঁরা বলবেন-ইসলামাবাদ সভ্য সরকারের পদবাচ্য? যদি বলেন, তাতে ক্ষতি নেই। সবাই জানে-চোরের মাসতুতু ভাই গাঁটকাটা। এদের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও থামবে না বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। অখণ্ড পাকিস্তানের অপমৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। বাকী আছে শুধু মাটি চাপা দেবার। ওটা করবেন বাংলাদেশ সরকার।
২০ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা