বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি
দুর্ভাগ্য একা আসে না। বাংলাদেশে গত কয় মাস ধরিয়া যাহা চলিয়াছে তাহাতে বলা চলে- দুর্যোগ-লহরী। ঢেউয়ের পর ঢেউ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অশ্রুতে নূতন বিষাদসিন্ধু রচিত হইতেছে। প্রথমে ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছাস। তাহার পর- হানাদার। নগর বন্দরে, গায়ে গঞ্জে লুঠেরা আর জল্লাদদের পদসঞ্চার। সত্তর লক্ষ মানুষ দেশ ত্যাগী হইয়াছেন। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্যোগ এখনও কাটে নাই। দুঃখের বারমাস্যায় এবার নাকি আসিতেছে দুর্ভিক্ষ। আর মন্বন্তর যদি আসে কে না জানে, সহযােগী হিসাবে মারী অবধারিত। সীমান্তের ওপারে এই দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা এপ্রিল মাস হইতেই শােনা যাইতেছে। ব্রিটেনের একটি ত্রাণসংস্থা জানাইয়াছিল অন্তত দুই কোটি মানুষ অন্নকষ্টে পড়িবেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের পর্যবেক্ষকেরাও উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন। পর্যবেক্ষকেরা সকলে একবাক্যে বলিয়াছেন পূর্ববাংলা একালের তুলনাহীন ট্র্যাজেডি। দুর্ভিক্ষ এই ট্র্যাজেডিতে স্বাভাবিক নিয়তি। পূর্ববাংলা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকা। এই এলাকা খাদ্যে স্বয়ম্ভর নয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন খাদ্য বিদেশ হইতে আমদানি করিতে হয়। সামরিক বাহিনীর লম্ফঝম্পের পর এবার অর্থাভাব, বন্দরের অভাব, যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাব। প্রথম অভাবটি পরদেশী বন্ধুদের ঔদার্যে দূর হওয়া সম্ভব, কিন্তু অন্যান্য সংকটের সমাধান কষ্টকর। এছাড়াও দুর্ভিক্ষের নানা আয়ােজন দেশে। ভারতের মতােই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গরীব। এ বছর তাহারা আরও গরিব। চাষবাস হয় নাই। কখনও পারিপার্শ্বিকের চাপে, কখনও বা হানাদারদের প্রতিরােধের প্রতিজ্ঞায়। ব্যবসা-বাণিজ্যও কার্যত বন্ধ। খাদ্য মিলিলেও চড়া দামে কেনা সম্ভব নয়। সুতরাং বাংলাদেশের সামনে আজ মন্বন্তর। বলা নিষ্প্রয়ােজন, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতােই এ মন্বন্তর মানুষের হাতে গড়া। তখন ছিলেন রেখা খাঁ, এখন ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ সঙ্গত কারণেই ইয়াহিয়া খানের কাছে কাম্য। যে দুর্জয় বাঙালীকে কামান-বন্দুকে হার মানানাে সম্ভব হয় নাই, তাহাদের এবার ক্ষুধায় বশ্যতা স্বীকার করাইবার চেষ্টা ইয়াহিয়া খান অবশ্যই করিবেন। মুজিবর বলিয়াছিলেন- হানাদারদের “ভাতে মারব, পানিতে মারব।” মনে হয় পশ্চিম-পাকিস্তানী হানাদারদের মনােগত ইচ্ছা ইহাই তাহাতে একাধিক সুবিধা। প্রথমত, নিঃশব্দে গণহত্যায় পরিকল্পনা চালু থাকিবে। দ্বিতীয়ত, গােলাগুলি খরচ করিয়াও যাহাদের তাড়ানাে যায় নাই, ক্ষুধার তাড়নায় তাহাদের একটা অংশ নিশ্চয় আবার দেশছাড়া হইবে। সত্তর-আশি লক্ষ ক্ষুধার্তের সঙ্গে আরও কয়েক লক্ষ যােগ হইলে ভারতের বিপদ আরও তীব্র হইবে। হয়তাে তখনই আসিবে ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রকৃত বিপর্যয়।
এই সম্ভাবনার দিকে চোখ বুজিয়া থাকিলে ভারত আবার হিসাব ভুল করিবে। বাংলাদেশ হইতে কত মানুষ সীমান্ত পার হইতে পারেন সে সম্পর্কে আমাদের অনুমান বারবার ভুল প্রমাণিত হইয়াছে। এখন বলা হইতেছে অঙ্ক আশি লক্ষে পৌছতে পারে। এটাকেও চূড়ান্ত মনে করিবার কোনও কারণ নাই। কেননা, সামরিক অভিযান এখনও চলিতেছে। মুক্তিফৌজের আক্রমণ যত তীব্র হইবে পাক-বাহিনীর দৌরাত্ম্যও ততই বাড়িবে। আজ যেখানে গড়ে চল্লিশ হাজার মানুষ সীমান্ত পার হইতেছেন, আগামী কাল তাহা দ্বিগুণ হইতে পারে । তাহার সঙ্গে অন্নাভাব যােগ হইলে তাে কথাই নাই, প্লাবন অনিবার্য। বস্তুত দেশ হইতে দেশান্তরে মানুষের যত অভিযান, সকলেই জানেন তাহার পিছনে অন্যতম তাড়না এবং প্রেরণা—ক্ষুধা। রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই ক্ষুধার বিরুদ্ধে কোনও সর্বাত্মক লড়াই চালানাে হইবে সেটা দুরাশী। প্রথমত ইয়াহিয়ার ফৌজ আজ ক্ষুধার্ত, তাহারাও ভাগ বসাইবে। দ্বিতীয়ত আগেই বলা হইয়াছে সরকারী নীতি যেখানে দেশকে জনশূন্য করিয়া নয়াপত্তন স্থাপন, সেখানে আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টাকে বানচাল করার চেষ্টাও চলিবে। তৃতীয়ত দুর্ভিক্ষের মতাে দুর্যোগ ঠেকাইবার জন্য যে প্রশাসনিক এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা দরকার বাংলাদেশে আজ তাহা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সুতরাং ভারতের সামনে বিকল্প আজ দুইটিই । হয়, আরও কয়েক লক্ষ শরণার্থীর জন্য তৈয়ারী হওয়া, না হয় বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসার জন্য দ্রুত কার্যকর কোনও পন্থা খুঁজিয়া বাহির করা। সহজতর কোনটি বলা শক্ত। পথ দুইটিই।
১৭ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা