বাংলাদেশ এবং পরদেশী দর্শকেরা | আনন্দবাজার পত্রিকা | ৩ জুলাই ১৯৭১
কেহই যেন আর অন্যের চোখে দেখিতে রাজী নহেন, সকলেই চাহেন বাংলাদেশের অবস্থাটা একবার স্বচক্ষে দেখিতে । যাহাকে বলে সরেজমিনে দেখা। ফলে কূটনীতিকদের গােপন বিবরণ, সংবাদপত্রের প্রকাশ ধারা বিবরণ ইত্যাদি সত্ত্বেও কিছু কিছু পশ্চিমী সন্দেহবাদী বঙ্গ দর্শনে বাহির হইতেছেন। ঢাকার সব পথই অবশ্য এখন ভায়া ইসলামাবাদ। সেখানে পাঠ লওয়ার পরই তবে বাংলা যাত্রা। ট্যুরিস্ট ম্যাপ তৈরি; ফেরার পথে কলিকাতা-দিল্লি । সম্প্রতি বাংলাদেশে যাওয়া আসা হইয়াছে মন্দ নয়, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের তরফে শ্ৰীকারগিলের বাংলা ভ্রমণ বাদ দিলে কাজ হইয়াছে যৎসামান্য। ভ্রমণকারীদের তালিকায় সর্বশেষ যােজনা-চারিজন ব্রিটিশ এম-পি। কমনওয়েলথ দফতরের ভূতপূর্ব মন্ত্রী আর্থার বটমূলির নেতৃত্বে এই পার্লামেন্ট সদস্য চতুষ্টয় যে বিবরণ পেশ করিয়াছেন তাহাতে অবশ্য নূতন কথা বিশেষ কিছু নাই, সংবাদপত্রের কল্যাণে বিশ্বযুদ্ধ মানুষ সবই ইতিপূর্বেই জানিয়া গিয়াছেন, কিন্তু ইহারা সে-সব বিবরণকে “সত্য” বলিয়া গ্রহণ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, আরও একটি সত্য মানিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছেন। তাহারা বলিয়াছেন- মুজিবর রহমানকে বাদ দিয়া বাংলাদেশে কোনও রাজনৈতিক মীমাংসা অসম্ভব। স্পষ্ট বক্তা হিসাবে সাহেবদের বিশেষ খ্যাতি নাই। তাঁহার সুখ্যতা বরং আধাে-আধাে অস্পষ্ট হেঁয়ালি ভরা কথাবার্তার জন্যই। এম-পিরা এবারও সে ঐতিহ্য যথাসাধ্য রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু পুরােপুরি রক্ষা করিতে পারেন নাই, তাহারা কবুল করিতে বাধ্য হইয়াছেন, তিনমাস পরেও বাংলাদেশের অবস্থা মােটেই স্বাভাবিক নয়। বরং-রীতিমত অস্বাভাবিক। তাহার প্রত্যক্ষ পরােক্ষ অন্য প্রমাণও রহিয়াছে। সদ্য ধড়া পড়া পাক সামরিক বাহিনীর চিঠিপত্র গুলিতে বাস্তব চিত্রটি উন্মোচিত। ইয়াহিয়ার ভাষণ, তস্য, ভৃত্য আমেদ সাহেবের বাজেট, সীমান্তের এপারে উদ্বাস্তু শিবিরে বর্ধমান ভিড়- সবই বলিতেছে অবস্থা অস্বাভাবিক। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা সে কথা বলিতে গিয়া আবার বিতাড়িত হইয়াছেন কে জানে, হয়তাে সদ্য আমন্ত্রিত অন্য সাংবাদিকদের ভাগ্যেও একই হুকুমনামা অপেক্ষা করিয়া আছে। একজন রক্ষণশীল ব্রিটিশ মহিলা এম পি যদিও সাফাই গাহিয়াছেন- ইয়াহিয়া খার আজ আর গােপন করিবার কিছু নাই, তবু সত্য এই,- ইয়াহিয়া খাঁর দেখাইবার মতও কিছু নাই। রাজনৈতিক মীমাংসা সম্পর্কে তাঁহার বক্তব্যের যে কানাকড়ি দাম নাই তাহাও আজ অনেকেই বুঝিয়া গিয়াছেন। অন্তত এই ব্রিটিশ এমপিরা তাে বটেই।
কিন্তু সকলে বুঝিয়াছেন কি? প্রশ্ন সেটাই। চারজন ব্রিটিশ রাজনীতিক বলিতেছেন-মুজিবর ছাড়া মীমাংসা সম্ভব নয়। দুইশত ব্রিটিশ এমপি বলিতেছেন-বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও। নিরাপত্তা পরিষদে পাক জঙ্গীশাহীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাও। সংবাদ পত্রে ক্রমাগত ধিক্কার-ইয়াহিয়ার প্রস্তাব অসৎ, অবান্তর, অর্থহীন। তাহারই মধ্যে নাকি ব্রিটিশ বন্দরে অস্ত্র বােঝাই জাহাজ দেখা যাইতেছে, লক্ষ্য- পাকিস্তান। আমেরিকা একাই বােধহয় পাতক নয়। ধাপ্পাবাজি ধরা পড়িবার পর সে এখন খােলাখুলিই ইয়াহিয়া প্রেমিক। স্টেট ডিপার্টমেন্ট সাফ বলিয়া দিয়াছে- আরও চার পাঁচ জাহাজ অস্ত্র যাইবে। | বাংলাদেশে পুনর্বাসন খাতে আমেরিকা নগদ টাকা দিতেও রাজি হইয়াছে। দেশের প্রভাবশালী সংবাদ। পত্রগুলি বলিতেছে পাকিস্তানকে সাহায্য করা অর্থ, গণহত্যায় সহযােগিতা করা, ওই উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক সাধনাকে বিপন্ন করা। সেনেটর কেনেডি তীব্র ভাষায় এই সিদ্ধান্তকে আক্রমণ করিয়াছেন। চেষ্টার বােলজ-এর মত প্রবীণ কূটনীতিক পাকিস্তানকে সাহায্য দানের কুফল সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দিয়াছেন। কিন্তু সরকার অনড়। হ্যারল্ড উইলসন স্বীকার করিয়াছেন কমনওয়েলথ অফিসে শক্তিশালী পাক-লবি” আছে, বােঝা যায় পেন্টাগনেও ইয়াহিয়ার বিস্তর ইয়ার দোস্ত আছেন। আর স্বদেশের জনসাধারণকে যাহারা ক্রমাগত ধাপ্পা দিয়া চলিয়াছেন তাহারা যে বাংলাদেশ বা ভারতের জনসাধারণকে ধাপ্পা দিতে পারিবেন- তাহাতে বিস্ময় কী। | পশ্চিমী দেশগুলির মধ্যে কথায় এবং কাজে এখন পর্যন্ত সঙ্গতি রাখিতে পারিয়াছে বােধহয় মাত্র দুইটি দেশ। এক-কানাড়া; দুই-পশ্চিম জার্মানী। কানাড়া পাকিস্তানকে অস্ত্ৰচালান বন্ধ করিয়াছে। রাজনৈতিক মীমাংসা বলিতে যে মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর বােঝায় তাহাও সরাসরি জানাইয়া দিয়াছে। ওদিকে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পিছনে অন্যতম কারণ নাকি পশ্চিম জার্মানীর চাপ। ব্যস্ তিনমাসব্যাপী দৌড়াদৌড়ি এবং হল্লার নীট ফল ইহাই। পূর্ব ইউরােপ অবশ্য এখন ধীরে ধীরে মুখ খুলিতেছে। | প্রেসিডেন্ট টিটো রাজনৈতিক মীমাংসা দাবি করিয়াছেন। দাবি করিয়াছে- বুলগেরিয়া। রাশিয়া সমেত গােটা পূর্ব ইউরােপের সহানুভুতি নাকি বাংলাদেশের প্রতি। ভারত হইতে শরণার্থীরা দেশে ফিরিয়া যান সেই দৃশ্যও দেখিতে নাকি সকলে আগ্রহী। কিন্তু সেটা সম্ভব কেমন করিয়া সে প্রশ্নে সকলেই মেীন। অর্থাৎ সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই রহিয়া গেল । আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় অভিমতের নিক্তি কাহার দিকে হেলে, ইয়াহিয়া অথবা বাংলাদেশের দিকে তাহা এখনও স্পষ্ট বােঝা যাইতেছে না। তবে এটুকু বােধ হয় ইতিমধ্যে স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে- যার যার লড়াই তাহাকেই লড়িতে হইবে। বাংলাদেশের সপক্ষে যে জনমত, বিশ্বাস করার হেতু আছে তাহাও রক্তের বিনিময়েই অর্জিত। কাহারও দয়ার দান নহে।
৩ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা