You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.29 | আফ্রো-এশীয় সংস্থার এই নীতিহীনতা - সংগ্রামের নোটবুক

আফ্রো-এশীয় সংস্থার এই নীতিহীনতা

অস্বীকার করা যায় না, বাংলাদেশের মহান মুক্তি-সংগ্রাম দুনিয়ার সব হাটে তাহার ন্যায্য প্রাপ্য পায় নাই। বিশেষত সরকারি মহলে। কেহ তােতলা, কেহ কালা, কেহবা বােৰা। যাঁহারা সরব তাহারাও সবসময় কথায় এবং কাজে এক নহেন। চরিত্রহীন এই বিশ্বে নির্ভেজাল আদর্শবাদ হয়তাে আশা করা অন্যায়। কথার আড়ালে মানুষের স্বাধীনতাকে হত্যার নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র বার বার দেখা গিয়াছে। সে সব হয়তাে বড় ঘরে বড় ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা এবার যাহাদের হাতে অপমানিত হইলেন তাহারা বিশ্বের তথাকথিত ভাগ্যবিধাতা বৃহৎশক্তিবর্গের কেহ নহেন, অপমানিত হইলেন নিজেদের আপনজন এশিয়া-আফ্রিকার ভূতপর্ব পরপদানত সম্প্রদায়ের হাতে। দামাস্কাসে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের দুইদিনব্যাপী বৈঠকে সাড়ে সাত কোটি স্বাধীনতাকামী বাঙালীর জন্য এক শশা তিরিশটি শব্দের এক ব্যবস্থাপত্র রচিত হইয়াছে। তাহাতে পূর্ব-বাংলায় ইয়াহিয়া বাহিনীর সুপরিকল্পিত গণহত্যার কথা নাই, বাংলাদেশের দুঃসাহসিক প্রতিরােধ সংগ্রামের কথা নাই । শুধু বলা হইয়াছে ঘটনাটি দুঃখজনক, এবং ইহার ন্যায়সঙ্গত মানবিক মীমাংসা কাম্য। দেশত্যাগীদের উচিত দেশে ফিরিয়া গিয়া পাকিস্তানের সমগ্র জনসাধারণের সঙ্গে একযােগে ঔপনিবেশিকবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং নব্য-ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালাইয়া যাওয়া। এই অন্তঃসারশুন্য অর্থহীন এবং কৃপণ বাক্যটিও নাকি ভারতীয় প্রতিনিধি দলকে রীতিমতাে দরবার। করিয়া আদায় করিতে হইয়াছে। দামাস্কাস আর রাবাত সম্মেলন এক নহে। আফ্রো-এশীয় সংহতি সমিতি নামে যে-সংস্থার কার্যকর সমিতির দশম বৈঠক দামাস্কাসে বসিয়াছিল, সকলেই জানেন এই আড্ডার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং পৃষ্ঠপােষক ভারত। বস্তুত বান্দুং হইতে শুরু করিয়া আফ্রো-এশীয় ধ্যান তাহার সযত্ন লালনায়ই এখন পর্যন্ত বাঁচিয়া আছে। সকলেই জানেন এই সংস্থার অন্যতম ঘােষিত লক্ষ্য ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে এশিয়া-আফ্রিকার সাধারণ মানুষের মুক্তি সংগ্রাম। আলজিরিয়া, টিউনিসিয়া, মরক্কো সকলেই তাহার সমর্থন পাইয়াছে।

সমর্থন পাইয়াছে- গােপন, প্রকাশ্য নানা বিদ্রোহ। কতজন মানুষ সেই বিদ্রোহের পিছনে আছেন, তাহাদের মূল লক্ষ্য স্বাধীনতা না গােষ্ঠীতন্ত্র- আফ্রো-এশীয় সংস্থা তাহা লইয়া বিশেষ মাথা ঘামায় । শীর্ষসম্মেলনে যে সতর্কতা, সংহতি পরিষদে তাহাও থাকে না; “বিদ্রোহ” “বিপ্লব” ধ্বনি উঠিলেই প্রতিধ্বনি শােনা যায়- “জিন্দাবাদ”। বাংলাদেশ উপলক্ষে জানা গেল- তাহারাও ব্যতিক্রম ঘটিতে পারে। সূর্যোদয়ের মতাে উজ্জ্বল একটি সত্যকেও মানবাধিকারের রক্ষকেরা অস্বীকার করিতে পারেন। তবে আর আমরা এই আড়ােয় থাকিব কেন? প্রশ্ন তুলিয়াছেন কুদ্ধ, ক্ষু, মর্মাহত, শ্রী-অরুণা আসিফ আলি। এই প্রশ্ন প্রত্যেক ভারতীয়ের। শ্রীমতী আসফ আলি এই সংস্থার ভারতীয় শাখার সহ-সভাপতি। তাহার অভিযোেগ একাধিক। প্রথমত, ভারতীয় প্রতিনিধিদের বক্তব্য কেহ কানে তােলে নাই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের কথা বলিতে দেওয়া হয় নাই। তৃতীয়ত, সমিতি ইচ্ছা করিয়াই পাকিস্তানকে নিন্দা করে নাই । অর্থাৎ প্রকারান্তরে এই সমিতি পাকিস্তানের বর্বরতাকে অনুমােদন করিয়াছে।

সে-দিক হইতে মানিতে হইবে বিশ্বশান্তি পরিষদ, কিংবা আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রীদের সম্মেলন অবশ্যই অনেক বেশি। হৃদয়বত্তার পরিচয় দিয়াছে। অথচ আফ্রো-এশীয় সংহতির সঙ্গে বাংলাদেশ ঘটনার যােগ ছিল অনেক বেশি প্রত্যক্ষ এবং জরুরী। আগেই বলা হইয়াছে সরকারি শীর্ষ সম্মেলন হইতে হয়তাে এই অতি-সতর্কতা, এভাবে এই মাপিয়া কথা বলার তবু একটা কৈফিয়ৎ দাঁড় করানাে চলিত, কিন্তু যে সংস্থার নাম “পিপলস সলিডারিটি অরগানাইজেশন” তাহার এই নীতিহীনতা ক্ষমার অযােগ্য। সরকার যেসব দেশে দ্বিধাগ্রস্ত, জনসাধারণ কিন্তু সে সব দেশেও প্রকাশ্য সহানুভূতি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ দেখাইতে ইতস্তত করে নাই, তােতলা হইয়া গেলেন কেবল তাহারাই, মানবিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সহযােগিতা করিতে যাহারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ইহাকে  বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে অজ্ঞতা বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া ঠিক নয়। এই ভ্রষ্টতার পিছনে অবশ্যই অন্য কারণ আছে। ঔপনিবেশিক অতীত ছাড়া আফ্রো-এশীয়ার দেশে দেশে ঐক্য কোনও দিনই ছিলনা। কখনও নাই। রাষ্ট্রপুঞ্জেও সব সময় একসঙ্গে চলা ইহাদের পক্ষে সম্ভব হইতেছে না; স্বার্থের নানা টানাপােড়েনে সকলেই নিজের ঘর লইয়া ব্যস্ত। তাছাড়া, নানাদেশে সামরিক চক্রের প্রতি দুর্বলতাও প্রকাশ্য। এমতাবস্থায় বিপন্ন পাক-জঙ্গীচক্রকে যে সমর্থনের চেষ্টা চলিবে সেটা মােটেই বিস্ময়কর নয়। বিস্ময়কর তাহার পরও সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে গরম গরম প্রস্তাব গ্রহণের ধৃষ্টতা। আরও বিস্ময়কর হইবে যদি ভারত ইহার পরও প্রাণহীন, লক্ষ্যভ্রষ্ট, বিকৃত-চরিত্র এই ক্লাবের সদস্য থাকিয়া যায়।

২৯ জুন ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা