এক ঢিলে তিন পাখি
একশত ও পাঁচ শত টাকার নােট বাতিল করিয়া পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী এক ঢিলে দুটি নয়, তিনটি পাখী মারিতে চাহিয়াছেন। প্রথম চিড়িয়াটি পাকিস্তান যাহাকে পয়লা নম্বর দুশমন বলিয়া মনে করে সেই ভারতবর্ষ। দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের বাসিন্দারা। তৃতীয়টি মুদ্রাস্ফীতি । ইয়াহিয়া খাঁর হিসাবে ৬০ কোটি পাকিস্তানী টাকা নাকি বাংলাদেশের সরকারি তােষাখানা এবং ব্যাঙ্কগুলি হইতে লােপাট হইয়াছে। সে টাকার সবটাই না হউক, বেশির ভাগই ভারতবর্ষের সরকারি তহবিলে কিংবা ব্যাঙ্কে জমা পড়িয়াছে বলিয়া তাঁহার ধারণা। একশত এবং পাঁচ শত টাকার নােট খারিজ করিয়া দেওয়ার ফলে যে টাকাটা ভারতবর্ষে পৌছিয়াছে সেটা বরবাদ হইয়া যাইবে। আর যে টাকাটা ভারতীয় নাগরিক কিংবা সরকারের হাতে নাই আছে বাংলাদেশের নাগরিকদের হাতে সে টাকাও তাে একরকম বাজেয়াপ্ত হইয়া গেল। সাহস করিয়া তাহারা তাে ওই সব নােট ভাঙাইবার জন্য পাকিস্তানী ব্যাঙ্কে জমা দিবে না। | আর জমা যদি দেয়ও তাহা হইলেও পুরানাে নােটের বদলে নূতন নােট যে পাকিস্তানী সরকার দিবেনই এমন প্রতিশ্রুতি তাঁহারা তাে মাথার দিব্য দিয়া দেন নাই। বরঞ্চ উল্টা কথাই তাহারা বলিয়াছেন । নােট ব্যাঙ্কে জমা দিলে রসিদ অবশ্যই পাওয়া যাইবে কিন্তু সেই রসিদ ভাঙাইয়া আনকোরা নূতন নােট কি ফিরাইয়া দিবেন এমন শর্ত তাহাদের বিজ্ঞপ্তিতে নাই । নােট যাহাৱা জমা দিবে তাহাদের কোথা হইতে কোন্ সূত্রে সে নােট পাইয়াছে তাহার একটা কৈফিয়ত দিতে হইবে। সে কৈফিয়ত সরকারের মনােমতাে হইলে টাকা পাওয়া যাইবে, নহিলে নয়। হয়তাে বা তখন নােটের দাবিদারকে জেলে পুরিয়া ঘানি টানানাে হবে। আর তাঘৎ বিধি নিষেধের বেড়া ডিঙাইয়া দাবিটা যদিও বা মঞ্জুর হয়, টাকাটা কবে মিলিবে সে সম্বন্ধে সরকারি বিজ্ঞপ্তি নীরব। অর্থাৎ টাকাটা ষােলাে আনা মারা যাওয়াও অসম্ভব নয়। জঙ্গীশাহীর নয়া বিধানে ঠকিবে চিরবঞ্চিত বাংলাদেশের বাসিন্দারা । তাহাদের রক্ত জল করিয়া উপার্জিত টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের বিদ্বেষের দরিয়ায় ভাসিয়া যাইবে, উদ্ধার করিবার কোনও উপায় থাকিবে না।
তাহারা যে কৈফিয়তই দিক না কেন, সেটা জঙ্গীশাহী নামঞ্জুর করিয়া দিবে। অতএব তাহাদের সব টাকাটাই মাঠে মারা যাইবে। আর তাহাদের জব্দ করাইতাে পাকিস্তানের ইচ্ছা। কাজেই অনুমাত্র করুণাও তাহাদের দেখাইবার- বাসনা পাকিস্তানের নাই। তবে এক ঢিলে ভারতবর্ষকে নাজেহাল করার দুরভিসন্ধি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। হইবে। শরনাগতদের দুর্দশা মােচনের জন্য আইন শিথিল করিয়া পাকিস্তানী মুদ্রার বদলে ভারতীয় নােট দেওয়ার নির্দেশ সরকারের তরফ হইতে দেওয়া হইয়াছিল বটে কিন্তু সে বাবদ সামান্য টাকাই জমা পড়িয়াছে। সে টাকাটা নষ্ট হইলেও এমন কিছু ক্ষতি ভারতবর্ষের হইবে না। আর নষ্ট হইবেই-বা কেন? আন্তর্জাতিক মুদ্রানীতি খেলাপ করা পাকিস্তানের পক্ষেও খুব সহজ হইবে বলিয়া বােধ হয় না। বিশেষ করিয়া বর্তমান পরিবেশে। মুদ্রাস্ফীতির ঠেলা সামলাইবার জন্য পাকিস্তান যদি ওই মতলব ঠাওরাইয়া থাকে তাহা হইলে সে গুড়ে বালি। কিছুদিন হয়তাে পুরানাে নােটের বদলে নূতন নােট দেওয়া স্থগিত রাখা যাইতে পারে। কিন্তু কলমের এক খোচায় কোটি কোটি টাকার নােট বরবাদ করিয়া দেওয়া যায় না। দিলে দেশে আর্থিক বিপর্যয় দেখা দিবে। অবশ্য বৈষয়িক দুর্যোগ পাকিস্তানে অনেক দিন আগেই দেখা দিয়াছে। সেটা মাত্রা ছাড়াইয়া গিয়াছে বাংলাদেশে নির্যাতন শুরু হওয়ার ফলে। এখন জমার ঘরে শূন্য অথচ ধারের বহর বাড়িয়াই চলিয়াছে। সে। তাল কী-নােট বরবাদ করিয়া এড়ানাে যায়? জিনিসের যেখানে প্রচণ্ড অভাব সেখানে দাম চড় চড় করিয়া বাড়িবে, হুমকি দিয়া সেটা বন্ধ করা অসম্ভভ। বাজার হইতে ফন্দী করিয়া কিছু নােট সরাইয়া লইলেও সমস্যার সমাধান হইবে না। তখন নােটের মূল্য শূন্য হইয়া দাঁড়াইবে নােটের তাড়া বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলিয়া দিয়া লােকে জিনিসের বদলে জিনিস চাহিবে এবং দিবে। যে বিপত্তি প্রথম মহাযুদ্ধের পর জার্মানি ও মধ্যইউরােপের দেশগুলিতে দেখা দিয়াছিল পাকিস্তানে তাহাই ঘটিতে চলিয়াছে নােট বাতিল তাহারই ইঙ্গিত।
১০ জুন, ১০৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা