বিশ্বের দুয়ারে ধর্না বৃথা
বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের সমাপ্তির কোনও লক্ষণ নাই, তবে আমাদের লােকসভায় বাংলাদেশ বিষয়ক বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটিয়াছে বটে। “উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত বলিয়া আরও একবার প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন, ইহা ছাড়া তাঁহার ভাষণে বিশেষ নতুন কথা নাই । পাকিস্তানী ব্যাভিচার সারা দক্ষিণ-এশিয়ার শান্তি নষ্ট করিতে তাৎপর্য স্পষ্ট হইতেছে না। সকলে যদি শান্ত থাকে, তাহা হইলে শাস্তি টুটিবার ভয় কোথায়? আহা, এ অঞ্চলে শান্তি এমনই অচলা থাকু, ইত্যবসরে সাড়ে সাত কোটি মানুষে ইহকাল-পরকাল পুড়িয়া ছাই হইয়া যাক। গণতন্ত্র বাঁচানাের জন্য মিত্রশক্তি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ লড়িয়াছিল, এখন কাহারও সাড়াশব্দ নাই, শ্ৰীমতী গান্ধী। সখেদে এই কথা স্মরণ করিয়াছেন। তিনি বােধহয় ভুলিয়া গিয়া থাকিবেন, সে রামও নাই সে অযােধ্যাও নাই। এবং ইতিমধ্যে বুড়াে পৃথিবীর বয়স আরও বত্রিশ বছর বাড়িয়াছে। তখন বৃহৎ শক্তি বলিতে বুঝাইত। ব্রিটেন আর ফ্রান্স এই দুইটি জাতি। তাহারা পুঁজিবাদী অপিচ সাম্রাজ্যবাদী,-তবু পােল্যান্ডকে দেওয়া। আশ্বাসের দাম রাখিতে নামিয়া পড়িতে ইতস্তত করে নাই। মিউনিকের আপসের প্রায়শ্চিত্ত সর্বস্ব দিয়া। করিয়াছে। কিন্তু মহাযুদ্ধের পরে দুনিয়ার অছিগিরি আর ছড়িদারি আমেরিকা আর রাশিয়া এই দুই মহাকায় দেশের উপর বর্তাইয়াছে কিনা কেহ গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী, কেহ সমাজতন্ত্রের তাই গণতন্ত্র ধর্ষনে নগ্ন নির্লজ্জ আস্ফালন দেখিয়াও উভয়েই বােবা কালা আর ঠুটো বনিয়া বসিয়া আছে। আমেরিকা দুইয়ের মধ্যে আরও ধড়িবাজ। প্রধানমন্ত্রী কি স্টেট ডিপার্টমেন্টের বয়ানটি দেখেন নাই? ধূর্ত মুখপাত্র বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত আর পাকিস্তান দুই দেশকেই সংযত হইতে পরামর্শ দিয়াছেন ।
একথায় এ ব্যাপারে ভারত আর পাকিস্তানকে একই রকম দায়ভাগী করার প্রয়াস-কূটনৈতিক শয়তানি ইহার চেয়ে বেশিদূর যাইতে পারে না। অর্থাৎ পিণ্ডি যা চায়, আমেরিকা অবিকল সেই কথার ফঁাদই বিছাইতে চাহিতেছে। এ বিষয়ে মহাচীনের সঙ্গে মার্কিনের প্রভেদ অল্পই, দুইয়ে মিলিয়া পিণ্ডিচক্রের চমৎকার তল্পিদারি চলিয়াছে। | প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বুঝিয়াছেন, নিজে জড়াইতে না চাহিলেও ভারতের রেহাই নাই, উহারা জড়াইয়া। লইবেই। বদনাম যাহা রটিবার, তাহা রটিবে। এই বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতের নিজের নীতি নূতন করিয়া নিকষে ঘষা চাই। বিশ্বের দুয়ারে ধর্ণা দেওয়া বৃথী। ইংরাজিতে বলে ‘চ্যারিটি বিগিনস্ অ্যাট হােম’– আপনি আচরি পরকে শিখাইলে হয় না? সময় আর স্রোত অবশ্য এই দুই মাসে অনেকখানি বহিয়া গিয়াছে। ভারতের পক্ষে চাপ দেওয়ার সেরা সুযােগ গিয়াছে প্রথম দশ দিনে। ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার কয়েদী’ দিল্লি সেই সময়টা হেলায় হারাইয়াছে। অথচ পাক নির্বাচনের পরে ভুট্টো ইয়াহিয়া চক্রের হালচালে সে যে অগ্রিম নােটিশ পায় নাই, এমন তাে নয়। যথেষ্টই পাইয়াছে, দিল্লি শুধু মনের দিক হইতে তৈয়ারি হইতে পারে নাই। সে যাচিয়া হাত না বাড়াইলেও বিপদ ঘাড়ে আসিয়া পড়িতে পারে, এই দূরদৃষ্টি আদৌ ছিল বলিয়া বােধ হয় না। বিপদ নানা দিকের- তাহার প্রমাণ লক্ষ লক্ষ শরণার্থী মানুষের হঠাৎ ঢেউ প্রমাণ আমাদের সীমান্তের পাক ফৌজের নিয়ত হামলা।
শ্ৰীমতী গান্ধী আগের দিন রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলিয়াছিলেন। জানি না যা বলিয়াছেন তাহার গভীর কোনও তাৎপর্য আছে কিনা। তিনি মুজিবের সঙ্গে একটা সমঝােতায় আসার জন্য পিণ্ডিশাহীর উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার কথা ভাবিতেছেন? মুজিব যদি সত্যই ধৃত হন বা ধরা দিয়া থাকেন তবে যােগাযােগের একটা রাস্তা আছে বটে। কিন্তু শুধু ওইটুকু। সমঝােতা হইবে কোন্ ভিত্তিতে? পিণ্ডির শাসকচক্র কি ছয় দফা বা চারদফা মানিয়া লইবে? আর মুজিবরই কি কোনও প্রকার ছাড়’-এ রাজী হইবেন? সে নেতৃত্বে তিনি অভিষিক্ত এবং অধিষ্ঠিত তাহাতে কোন প্রকার অসম্মানজনক আপস অসম্ভব। যে দলের আহ্বানে একটি জাতি অকাতরে প্রাণ দিতেছে, সেই দল জাতিকে মান বিকাইয়া দিতে বলিতে পারেনা। বলাটা আত্মহত্যার সমতুল হইবে। অবশ্য এ দেশে বিদেশে অনেক মহল এখন শকুনির মতাে সেই অপেক্ষাতে রহিয়াছে। আওয়ামী লীগ তাহাদের মনের কাটা, কেননা এই দল কোনও তাত্ত্বিক পুঁথির সঙ্গে মিল রাখিয়া, কোনও পণ্ডিতী ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে তাল রাখিয়া প্রভাব ও প্রাধান্য অর্জন করে নাই। সেইজন্যই কবে আওয়ামী লীগ একেবারে নির্জিত হয়, হতাশ অসহিষ্ণু বিরক্ত তত্ত্বভক্তদের সেই অপেক্ষা। সেইজন্যেই থাকিয়া থাকিয়া আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য দল লইয়া বাংলাদেশের কোয়ালিশন বা জাতীয় সরকার গড়ার কথা ওঠে। আসল কথা বখরা চাই।
বােঝা শক্ত জাতীয় সরকার গড়ার কথা উঠিতেছে কোন্ গণতান্ত্রিক যুক্তিতে। যে দল ভােটের বারাে আনা ভাগ। পাইয়াছে আর আসনের শতকরা ৯৯ টি, সেই দল কি যথেষ্ট “জাতীয়” নয়? স্বীকার করি এই সত্যটা স্বীকার করিতে তত্ত্বাচ্ছন্ন বুদ্ধিতে কষ্ট হয়। | আওয়ামী নেতৃত্বের পরাভব বা পরাজয় ব্যাপারটাও একটা অপপ্রচার, মতলব মাফিক ফাপানাে এবং বাড়ানাে। রণাঙ্গণে অসম শক্তির সঙ্গে যুঝিয়া সাময়িকভাবে যদি পিছু হটিতেও হইয়া থাকে তবু এই ঢালের ও উজ্জ্বলতর একটা দিক আছে। “পরাজয় পরাজয়” বলিয়া যাহারা গলাবাজি করে তাহারা সে-দিকটা দেখিতে পান না। খান-সেনারা হানাদারির দুই মাস পূর্ণ হইয়া গিয়াছে, তবু তাহারা আজ পর্যন্ত একটাও “পুতুল সরকার” গড়িতে পারিয়াছে কি? একটা জাতির প্রতিজ্ঞার আর দৃঢ়তার এইটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ। হিটলার কিন্তু ইহার চেয়ে অনেক অনায়াসে একজন পেতা, একজন কুইসলিং খুঁজিয়া পাইয়াছিল। ইয়াহিয়া শাহী পায় নাই। আওয়ামী লীগের অসাফল্য লইয়া যাহারা বাচালতা করেন, তাহারা বলুন পূর্ববঙ্গের কোথাও কি খানশাহী এ পর্যন্ত সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশান বলিতে যা বােঝায় তাহা চালু করিতে পারিয়াছে? কোথাও কী। স্বাভাবিক জনজীবন সচল হইয়াছেঃ ইয়াহিয়ার চেলাদেরই বা তবে সাফল্য কোনখানে?
২৮ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা