একলা চল রে
পাকিস্তানের বাহাদুরি আছে বটে; এক ছিপে পশ্চিমী রুই-কাতলা; আর পূর্ব বিলে চিতল-বােয়ালকে গাথিয়া একসঙ্গে খেলানাে একটা অসম্ভব কাণ্ড বলিলেই হয়। কিন্তু সেই অসম্ভবকেই পাকিস্তান সম্ভব করিয়াছে। তাহাতে একদিকে মদত দিতেছে আমেরিকা এবং ব্রিটেন, আর এক দিকে চীন এবং রাশিয়া। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিস্তর চুনােপুঁটিও তাহার বড়শিতে গাঁথা। ইহার পরও যদি পাকিস্তানের যা খুশি তাই করিবার ইচ্ছা প্রবল হইয়া না ওঠে তাে হইবে কিসে? বাংলাদেশে পাকিস্তানী ফৌজ যে রক্তগঙ্গা বহাইয়া দিতে সাহস পাইয়াছে তাহার জন্য রাওলপিণ্ডির বন্ধুভাগ্য কম দায়ী নয়। বিশ্ব জনমতের পরােয়া ইয়াহিয়া খার জঙ্গিশাহী যে করিতেছে না তাহার কারণও দুনিয়ায় তাবৎ দিকপাল রাষ্ট্রের অস্বাভাবিক পাকিস্তানপ্রীতি। তাহাদের একজনও যদি বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার নিন্দা করিত তাহা হইলেও- ইয়াহিয়া খাঁর এত বাড় বাড়িত-না। নয়াদিল্লির কিন্তু দেখিতেছি ইঙ্গ-মার্কিন জোটের উপর অগাধ বিশ্বাস। রাশিয়ার উপর তাে বটেই। একমাত্র চীন সম্পর্কে তাহার কোনও ভ্রান্ত ধারণা নাই। বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার সময় হইতেই পাকিস্তানকে প্রজাতন্ত্রী চীন যে অস্ত্রশস্ত্র যােগাইতেছে সে কথা কবুল করিয়াছেন লােকসভায় রাষ্ট্রমন্ত্রী ভি সি শুক্লা । কিন্তু অন্য তিনটি বৃহৎ রাষ্ট্র সম্পর্কে ভারত সরকার এখনও আশাবাদী- তাহারা পাকিস্তানের আচরণে কুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ কেহ বুঝাইয়া বলিলেই তাহারা ইয়াহিয়া খার উপর চাপ দিবে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচনী রায় মানিয়া লইতে ইহাই তাহাদের প্রত্যাশা। গণতন্ত্রী ব্রিটেন ও আমেরিকা এমনভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আদর্শকে হত্যা করিতে দিবে না। সর্বহারার দেশ রাশিয়া সেখানে নিষ্ঠুর গণহত্যা নীরবে সহ্য করিবে না। ভারত সরকারের কাণ্ড কারখানা দেখিয়া হাসিও পায়, কান্নাও আসে। বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া। খার অত্যাচারের নির্মম দৃশ্য তাঁহারা যে চুপ করিয়া দেখেন নাই, সেটা তাহাদের আদর্শ-নিষ্ঠার পরিচয়। কিন্তু তামাম দুনিয়া এ ব্যাপারে তাহাদের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইবে, এতটা আশা করা তাহাদের পক্ষে সঙ্গত। হয় নাই। কঠোর বাস্তব রাজনীতি সম্বন্ধে অনেক কিছুই যে তাঁহাদের অজানা তাহাদের আচরণেই তাহার।
প্রমাণ চার বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে একমাত্র রাশিয়াই ইয়াহিয়া খাঁর নবমেধ যজ্ঞ সম্বন্ধে উদাসীন হইয়া থাকে নাই- পত্র লিখিয়া তাহার কুকীর্তির নিন্দা করিয়াছে। অন্যেরা তাে আজও পর্যন্ত মুখটি খােলে নাই যে পাকিস্তানের আচরণের বিরূপ সমালােচনা করিবে। তবে রাশিয়াও গােটা-দুই পত্র লিখিয়াই খালাস। বাংলাদেশকে ধ্বংসের মুখ হইতে বাচাইবার একক বা যৌথ কোনও প্রচেষ্টাই সে করে নাই। আর ব্রিটেন ও আমেরিকা সম্পূর্ণ নির্বিকার, যেন একটা ভাষাগােষ্ঠীকে সমূলে উচ্ছেদ করার ব্যাপক চেষ্টা পাকিস্তান। বাংলাদেশে করিতেছে না। ভারতবর্ষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দরজায় দরজায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহাদের পাকিস্তানের এই অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবহিত করিতে। সে প্রচারকার্য যে নিন্দার এমন কথা বলিনা। কিন্তু নয়াদিল্লির দিকপালদের মনে রাখা প্রয়ােজন যে, এটি নিতান্তই নিষ্কাম কর্ম-ফলে আশা করিলে তাহারা ঠকিবেন। বিশ্ববিবেককে তাহারা জাগাইয়া তুলিতে পারিবেন এমন ভরসা তাঁহারা যেন না রাখেন। পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার উপায় তাহাকে বৈষয়িক ও সামরিক সাহায্য দুই-ই দেওয়া বন্ধ করা। দুনিয়ার রাজধানীতে রাজধানীতে সে আবেদনই ভারতবর্ষের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিরা জানাইতেছেন। কিন্তু ফল তাে কিছুই হয় নাই। হইবে বলিয়া মনেও হয়না । ব্রিটেন তাে সাফ বলিয়া দিয়াছে আর্থিক সাহায্য স্থগিত রাখার মতাে অন্যায় কাজী সে কিছুতেই করিতে পারিবে না। যদি কেহ মনে করিয়া থাকেন এসব টোরিদের কীর্তি তাহা হইলে তাহাদের ভুল ভাঙিয়াছে সােসালিষ্ট ইন্টারন্যাশনালে শ্রী উইলসনের আচরণে। জয়প্রকাশ নারায়ণকে বাংলাদেশে। পাকিস্তানী নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে তিনি বলিতেই দেন নাই পাছে ইয়াহিয়া খাঁ চটিয়া যান। প্রকাশ্যে কিছু না। বলিলেও আমেরিকার মনােভাবও ভিন্ন নয়। কাজেই কিছু করা দূরে থাকুক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু বলিতেও তাহারা নারাজ। বাংলাদেশের ব্যাপারে একলা চলা ছাড়া ভারতবর্ষের দ্বিতীয় পথ নাই।
১ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা