You dont have javascript enabled! Please enable it! নও শুধু ছবি - সংগ্রামের নোটবুক

নও শুধু ছবি

 

সংবাদচিত্রে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে উলঙ্গ এক শিশু তাহার গুহ জীবনের একটি সম্পদ বস্তু মাথায় করিয়া দূরান্তের কোন নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে হাঁটিয়া চলিয়াছে। গােটানাে একটি মাদুর; ইহাই হইল ওই ছােট্ট  শিশুর মাথার বােঝা। বুঝিতে অসুবিধা নাই, সে হইল নিতান্ত এক গরিবের ঘরের শিশু। কিন্তু তাহার জীবনকে চরম নিঃস্বতা ও রিক্ততার মধ্যে নিক্ষেপ করিয়াছে নিদারুণ এক সশস্ত্র হিংসার অত্যাচার। যে পাকিস্তানী ফৌজের বীভৎস নিঃশ্বাসের স্পর্শ পূর্ব-বাংলার বায়ু বিষাইয়াছে, তাহারই লক্ষ গৃহের সন্ধ্যাদীপের আলাে নিবাইছে তাহারই তাড়না ভারতীয় অঞ্চলে প্রবেশ করিয়া গ্রামবাসীর সংসারের উপর অগ্নি নিক্ষেপ করিয়াছে। বুঝিতে হয় পাপের সাহস সীমা অতিক্রম করিয়াছে। | পূর্ব-বাংলার মাঠে ঘাটেও এই একই দৃশ্য । ঘরছাড়া মানুষের দল যাযাবরের মিছিলের মতাে-সীমান্তের  দিকে চলিয়াছে। সংবাদ চিত্র তাহাদের দুঃখের ক্লেশের ও মর্মবেদনার রূপ কতটুকুই বা পরিবেশন করিতেছে। শতাংশের একাংশও নহে। অনেকে জানে, পুরাতন ভিটার মায়া ছাড়া তাহাদিগকে পিছনে টানিবার মতাে অন্য কোন মায়া আর নাই । ঘরের সব মানুষকে নারকীরা হত্যা করিয়াছে। অনেকে জানে, আপনজন যাহারা ছিল তাহারা যেন করাল অন্ধকারের মধ্যে হারাইয়া গিয়াছে। তাহারা বাচিয়া আছে বলিয়া বিশ্বাস করিবার মতাে কোন সংবাদ নাই। প্রিয় পরিজনেরা যেন ভয়ানক এক ঠিকানাবিহীন পরিনামের মধ্যে সমাহিত হইয়া গিয়াছে। | না, নও শুধু ছবি। বলিতে হয় এইসব ছবি বস্তুত এক-একটি মূর্ত কাহিনী।

কাল্পনিক পিশাচ ও দানবের কাহিনী নহে, একেবারে বাস্তব ঘটনার রক্তমাংস দিয়া নির্মিত কাহিনী। মাতা কপালে করাঘাত করিয়া কাঁদিতেছে মনে পড়িতেছে পাকিস্তানী হিংস্রতার বুলেট ও বেয়নেটের আঘাতে নিহত পুত্রটির রক্তাক্ত দেহপিণ্ড সেই উঠানের উপর পড়িয়া আছে। তরুণী বধূ দুই চোখে আঁচল চাপিয়া ফুপাইয়া উঠিতেছে। মনে পড়িতেছে পাকিস্তানীর অস্ত্রাঘাতে নিহত স্বামীর রক্তের ছােপ ঘরের দেওয়ালের গায়ে লাগিয়া আছে। শ্বশুর ভাত খাইতে বসিয়াছিল পুত্রবধূ ভাতের থালা হাতে লইয়াই আর্তনাদ করিয়া উঠিল । পিঁড়ির উপর রক্তাক্ত হইয়া পড়িয়া আছে শ্বশুরের দেহ, পাকিস্তানীর বন্দুকের গুলিতে স্তব্ধ হইয়া গেল একটি শান্তু নিরীহ প্রাণ। ব্রতের জন্য আলপনা আঁকিয়াছিল কিশােরী। সে এখন পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু শিবিরের এক কোণে বসিয়া ডুকরাইয়া উঠিতেছে। মনে পড়িতেছে সেই বিভীষিকার দৃশ্য। ফুলগাছের তলায় ছােট ভাইটিকে হত্যা করিয়া পাকিস্তানী জল্লাদ-সৈনিক ভাইয়ের শােণিত্যক্ত দেহটিকে আলপনার উপর আছড়াইয়া ফেলিয়া দিল।  দানবেরা নিশ্চয় কল্পনা করিতে পারে না যে, ইতিহাসের পরিণামের পৃষ্ঠাতে আর-এক রকমের ছবি অঙ্কিত হইয়াছে। সেই ক্রুরতাগর্বী নাদির শাহের কাঠের বক্ষ রক্তে ভাসিয়া যাইতেছে, আততায়ীর ছুরিকা নাদিরের বক্ষে বিদ্ধ হইয়াছে। হুন আটিলা তাহার বিবাহের আসরে উপনিবেশ করিয়াই আর্তনাদ করিতেছে, আততায়ী তাহাকে অস্ত্রাঘাতে হত্যা করিতেছে। মুসােলিনীর শবের উপর থুতু ছিটাইতেছে জনতা। এবং জীবন্ত হিটলার একটি গােপন গহ্বরের ভিতরে পুড়িয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইতেছে ।

১ মে ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা