ভয় তাহাদের পিছু লইয়াছে
কামান নয়, বন্দুক নয়, লাঠি কিংবা বল্লম নয়, নেহাতই এক পশলা শিলাবৃষ্টি অথচ তাহারই ঠেলায় ইয়াহিয়ার বীরপুঙ্গদের নাকি দাঁতকপাটি লাগিবার উপক্রম হইয়াছিল। পশ্চিমের মরুভূমি হইতে হাজারে হাজারে উড়িয়া-আসিয়া জুড়িয়া বসিয়াছে, উদ্দেশ্য সােনার বাংলাদেশকে ছারখার করা, অথচ সেখানকার ভূপ্রকৃতি আর জলবায়ু সম্পর্কে কোনও ধারনাই নাই, বৈশাখের ঝড় বাদলকে যাহারা ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কারসাজি বলিয়া ধরিয়া লয়, জবরজঙ্গী, সেই পঙ্গপালদের এবারে শিলাবৃষ্টির চড় খাইয়া চমকাইয়া উঠিবার পালা। নিতান্ত চিত্তের চমক নয়, বাংলাদেশের সংবাদে প্রকাশ, খানের সিপাহীদের প্লীহাসুদ্ধ চমকাইয়া উঠিয়াছিল। তাহারা ধরিয়া লইয়াছিল, এ আর কিছুই নয়, মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র মুক্তিযােদ্ধারা বুঝি-বা আকাশ হইতে হিমবাণ নিক্ষেপ করিয়া তাহাদের নিকাশ করিয়া ছাড়িবে। প্রাণ বাঁচাইবার জন্য তৎক্ষণাৎ তাহারা গুলি চালাইতে শুরু করে। স্রেফ শিলাবৃষ্টির মার ঠেকাইতে নাকি বিস্তর গুলিগােলা তাহাদের খরচ হইয়া গিয়াছে। ‘শিলাবৃষ্টির মার’ বলিয়াছি’, ‘ভগবানের মার’ বলিলেও ভুল হয়না। বৎসরের এই সময়টাতে অবশ্য ঝড় বাদল কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় ? তবু লক্ষণীয়, তাহার প্রকোপ এবারে একটু অস্বাভাবিক রকমের। প্রায় নিত্যদিনই পুঞ্জমেঘের কেশর নাড়িয়া ঝড় উঠিতেছে; আকাশের চক্ষু হইতে যেন-বা রােম সৃষ্টির মতােঝলকাইয়া উঠিতেছে বিদ্যুতের অগ্নিজ্বালা; তৎসহ প্রায় নিত্যদিনই প্রবলধারে বৃষ্টি নামিতেছে। মার বইকী। ঈশ্বরের মার। ক্ষমতার মদে মত্ত ফৌজী শাসকগণকে কাদার মধ্যে নগ্নজানু করিবার ব্যবস্থা। মুক্তিবাহিনীর মারের সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে দৈব মার। দিন কয়েক আগেও কিন্তু প্রকৃতির চেহারা ছিল ভিন্ন।
এক বিদেশি সাংবাদিক তখন রণাঙ্গনের খবর দিতে গিয়া লিখিয়াছিলেন, “আম কাঁঠালের ডালে ডালে সবুজ টিয়াপাখির খেলা, মাঠের উপরে গরু চরিতেছে; ওখানে যে যুদ্ধ চলিতেছে, হঠাৎ দেখিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই।” এখন কিন্তু প্রকৃতির চেহারা একেবারে অন্যরকম। | সত্য বটে, মানুষের সংসারের অবস্থাটা যে কেমন, প্রকৃতির সংসারে চোখ রাখিয়া অনেক সময়েই তাহা বুঝিয়া ওঠা যায় না। আবার কখনও কখনও যায়ও। এখন যেমন যাইতেছে। সাতকোটি মানুষ যখন একপ্রাণ হইয়া দখলদার ফৌজের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়িতেছে, প্রকৃতিও তখন দুঃশাসকদের প্রতিকূলে। কল্পনা করা যাক সেই রােমাঞ্চকর দৃশ্যটিকে। শুন্য হইতে চড়বড় করিয়া শিলাবৃষ্টি হইতেছে এবং ফৌজী সিপাহীরা আকশের বুক ফুটা করিয়া দিবার জন্য উর্ধ্বমুখ হইয়া বন্দুক চালাইতেছে। শিলাপাত যখন থামিয়া গেল, তখন নিশ্চয় কমাণ্ডার সাহেব গোঁফে চাড়া দিয়া বলিয়াছিলেন, যাক, উহাদের তাড়াইয়া ছাড়িয়াছি। কিন্তু ভয় কাটিল কি? পাপ যাহারা করিয়াছে, করিতেছে, ভয় তাহাদের নিত্যসঙ্গী, আতঙ্ক এখন সারাক্ষণ তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিবে। শুধু ঝড় বাদল আর শিলাবৃষ্টি কেন, বাংলাদেশের প্রতিটি ঝােপঝাড়ে এখন তাহাদের ভূত দেখিয়া ভয় পাইবার সময়, প্রতিটি প্রান্তরে আলেয়া দেখিয়া আঁকাইয়া উঠিবার পালা। বটের ঝুরি দেখিয়াও তাহারা এখন ভাবিবে যে, তাঁহাদের ফাঁসির দড়ি ঝুলিতেছে। চাই কী, নিজের ছায়াকেও তাক করিয়াও এখন তাহারা বন্দুক চালাইতে পারে।
২৩ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা