You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.22 | কূটনীতির কুটিল লড়াই - সংগ্রামের নোটবুক

কূটনীতির কুটিল লড়াই

পাকিস্তান বায়না ধরিয়াছে কলিকাতার বেদখল দূতাবাস তাহার হাতে আবার তুলিয়া দিতে হইবে, আসবাবপত্র, সাজ-সরঞ্জাম, দলিল-দস্তাবেজ, টাকা-কড়ি। সঙ্গে সঙ্গে একথাও জানাইয়া দিয়াছে, নূতন যে ডেপুটি হাই কমিশনারকে এ মহানগরীতে পাঠানাে হইয়াছে তাহাকে যেন দস্তুরমত খাতির যত্ন করা হয়। ইসলামাবাদে খবর গিয়াছে সার্কাস অ্যাভেনিউতে ডাকাত পড়িয়া পাকিস্তানের সর্বস্ব লুটিয়া লইয়াছে। সে ডাকাতকে শায়েস্তা করার বরাত নয়াদিল্লির হাই কমিশন মারফত ভারতবর্ষকেই দিয়াছে পাকিস্তান। সে চিঠির বয়ানটা আবার কিঞ্চিত মিঠে-কড়া। পাকিস্তানী আবদার না মানিলে কাজটা নাকি অমিত্রোচিত হইবে এবং ভারতবর্ষকে তাহার ফল ভােগ করিতে হইবে, এমন শাসানিও সে পত্রে আছে। পাকিস্তান যে ভুলিয়াও কখনও ভারতবর্ষকে মিত্রের পর্যায়ে ফেলিয়াছে, এটা একটা খবর বটে। তাহার আবদার মানিয়া লওয়া তাে এদেশের সাধ্যের অতীত। নয়াদিল্লির পাকিস্তানী হাইকমিশন এবং তাহার ইসলামাবাদের মুরুব্বীর দল ভালই জানে কলিকাতার সার্কাস অ্যাভেনিউয়ের নয় নম্বর কুঠিতে যে পালাবদল হইয়াছে তাহার দায়দায়িত্ব সব পাকিস্তানের, ভারতবর্ষের কোনও সম্পর্ক তাহার সহিত নাই । ক্ষোভে, ঘৃণায়, লজ্জায় কোনও পাকিস্তানী কূটনৈতিক যদি ইসলামাবাদের ছায়া মাড়াইতে চান তাহা হইলে তাহাকে হুজুরে হাজির করার দায় কি নয়াদিল্লির? পাকিস্তান সরকার পারেন তাহাদের সঙ্গে বােঝাপড়া করুন, না পারেন হাল। ছাড়িয়া দিন। কিন্তু তাহাদের ব্যাপারে ভারতবর্ষ নাক গলাইতে যাইবে কোন্ দুঃখে? যে বাড়িতে এতদিন পর্যন্ত কলিকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনের দপ্তর ছিল সেটা তাে আর ভারত সরকার কিংবা পশ্চিম বঙ্গ সরকার জবরদখল করেন নাই। কাজেই এ ব্যাপারে তাঁহারা কী করিবেন। | তবে পাকিস্তানের মতাে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি কিংবা আইনকানুন ভাঙিতে ভারতবর্ষের আগ্রহ নাই। পাকিস্তানী কূটনীতিককে নিয়মমাফিক সুযােগ-সুবিধা নিশ্চয়ই দেওয়া হইবে।

কিন্তু বেদখল বাড়ি উদ্ধার কিংবা সেখানকার বাসিন্দাকে উচ্ছেদ এ সব সে সুযােগ সুবিধার মধ্যে পড়ে না। তাহার জন্য পাকিস্তানকে আদালতের দ্বারস্থ হইতে হইবে। ঢাকাতে যেমন ভারতীয় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা বলিয়া কিছু নাই, কাজকর্ম করাও দায়, কলিকাতায় যে পাকিস্তানী কূটনীতিকদের দশা তেমন হইবে না- এ গ্যারান্টি এ দেশের সরকার দিতে পারেন, তাহার জন্য পাকিস্তান সরকারকে আবেদনও করিতে হইবে না। পাকিস্তানের মতাে আন্তর্জাতিক আইন-লঙ্ঘনে তাহারা পটু নন, ইসলামাবাদের মত হয়কে নয় করিতেও নয়াদিল্লি পারে না। এদেশের একটা যাত্রিবাহী বিমান ছিনতাই করিয়া লইয়া গিয়া তাহার জন্য অম্লানবদনে ভারতবর্ষকেই দোষী করিতে একমাত্র পাকিস্তানই পারে। অমন দিন-দুপুরে পুকুর চুরি ভারতবর্ষের কর্ম নয়। পাকিস্তানও সে কথা বিলক্ষণ বােঝে। তবু জানিয়া-শুনিয়াই সে ভান করিতেছে। দুনিয়ার চোখে ধূলা দিয়া নিজের কাজ হাসিলের মতলবে সে আছে। সে কাজ হইতেছে বাংলাদেশের ঘটনার মিথ্যা ও বিকৃত বিবরণ সারা জগতে প্রচার করা। দীর্ঘকাল অত্যাচার ও অনাচারে জর্জরিত হইয়া বাংলাদেশের নাগরিকরা যে নিরুপায় হইয়াই প্রতিকারের আশায় স্বাতন্ত্রের পথ বাছিয়া লইয়াছে, ওই অপ্রিয় সত্যটা পাকিস্তান গােপন রাখিতে চায় । অবলীলাক্রমে তাই সে রটাইতেছে, বাংলাদেশে সবই শান্ত, অশান্তি যেটুকু আছে সেটুকুর মূলে। আছে ভারতবর্ষের উস্কানি । ইসলামাবাদের এমনই মন্দভাগ্য যে এক প্রজাতন্ত্রী চীন ছাড়া অমন নির্জলা মিথ্যা নিখিল-বিশ্বে কেহ বিশ্বাস করে নাই। পাকিস্তান রাগে গরগর করিতে করিতে তাই ফিকির খুঁজিতেছে, কেমন করিয়া ভারতবর্ষকে অপদস্থ করা যায়। সােজাসুজি আক্রমণ করিবার দুঃসাহস তাহার নাই। কিন্তু দুরাত্মার তাে আর ছলের অভাব হয় না। তাই পাকিস্তান শুরু করিয়াছে কূটনৈতিক লড়াই। নানা উপলক্ষ্যে নয়াদিল্লিকে পত্রাঘাত করিতেছে, রেডিও মারফত বিদ্বেষের বিষ ছড়াইতেছে যদি ধৈর্যহারা হইয়া একটা কিছু কাণ্ড ভারতবর্ষ করিয়া বসে।

দুই দেশ, দুই জাতি

পাকিস্তান যে দুইটি ভিন্ন দেশ এবং দুই দেশ মিলিয়া যে এক জাতি নয়, তাহার জন্য আর ভূগােল ইতিহাস কিংবা সমাজ-সংস্কৃতিতে প্রমাণ খুঁজিবার প্রয়ােজন নাই। প্রমাণ-ভূট্টো-ইয়াহিয়া-চক্রের আচরণ। “নিজের দেশের জনসাধারণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ-ঘােষণার এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। ইয়াহিয়া বিশ্ববাসীকে সাফ জানাইয়া দিয়াছেন ভূতপূর্ব পূর্বপাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ নামক দেশটি পশ্চিমপাকিস্তান হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক দেশ,- “শত্রুর-দেশ। পাকিস্তানের দ্বিজাতিত্ত্বের সমর্থনে আর এক প্রমাণ উপস্থিত করিয়াছেন বিদ্রোহী কূটনীতিক হােসেন আলি। তিনি বলেন- বাংলাদেশ যে পৃথক দেশ তাহার প্রমাণ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কোনও উল্লেখযােগ্য অংশ পূর্ববাংলায় গণহত্যার বিরুদ্ধে মৌখিক প্রতিবাদও জানাই নাই। তাহাদের নীরবতা কি ইয়াহিয়ার প্রতি পরােক্ষ সমর্থন নয়? 

হােসেন আলি সাহেবের এই উক্তি বিচার করিয়া দেখিবার মতাে। আমরা জানি সবদেশের সাধারণ মানুষ মােটামুটি এক। তাহারা সরল, শান্তিপ্রিয়, এবং অন্য দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন নন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইহাও অস্বীকার করার উপায় নাই যে, দেশে দেশে যুদ্ধে এই সাধারণ মানুষই আবার সগর্বে জাতীয়তার মন্ত্র আওড়ান, সানন্দে কামানের মুখে আগাইয়া যান। কেন, তাহার ব্যাখ্যা এখানে অবান্তর। সত্য এই, কখনও কখনও তাহারা ধোকায় পড়িতেও সম্মত। শুধু তাহাই নহে, ইতিহাসে এ ধরনের আরও কিছু কিছু আজব কাণ্ডও ঘটে। একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ রাষ্ট্রনীতিবিদ্‌ বলিয়াছিলেন- ব্রিটেনে দুই জাতি। এক জাতি ধনপতিদের, আর এক জাতি গরিবের। কিন্তু সময়বিশেষে যেমন সমগ্র ব্রিটিশ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এক জাতি  হিসাবে দাঁড়াইতে দেখা গিয়াছে, ঠিক তেমনই এই দৃশ্য দেখা গিয়াছে দুই দেশের ধনী, কিংবা দুই দেশের গরীব সর্বক্ষণ পরমাত্মীয়ের মতাে ব্যবহার করিতেছে না। দুনিয়ার শ্রমিক এক হও”- এই আহ্বান এখনও সম্পূর্ণ অর্থবহ নহে। চট্টগ্রামে শ্রমিকেরা যখন মাল খালাস করিতে অস্বীকার করিতেছেন, করাচিতে তখন কি। শ্রমিকেরাই জাহাজে অস্ত্র আর রসদ বােঝাই করিতেছেন না? | তবু আধুনিক কালে জনসাধারণ এবং শাসকদের আলাদা করিয়া দেখাই প্রচলিত নিয়ম। বিশেষ করিয়া। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই নিয়মটি অবশ্যই প্রযােজ্য। সেখানকার জঙ্গীচক্র নিশ্চয়ই জনপ্রতিনিধিত্বের দাবি করিতে পারে না। এই গােষ্ঠী আর যাহারই প্রতিভূ হােক, কিছুতেই জনগণের নহে। কিন্তু আপাতত তাহারা। যে জনসাধারণকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া রাখিতে সমর্থ হইয়াছে, জুলফিকার আলি ভূট্টোর আচরণে তাহার ইঙ্গিত মিলিতেছে। ইয়াহিয়াকে তিনি প্রয়ােজনীয় গণ-সমর্থন জোগাইবার কাজে ব্যস্ত। পশ্চিম-পাকিস্তানে ইহাদের। সাফল্যই প্রমাণ করিতেছে পূর্ব-বাংলার প্রতি পশ্চিমের মানুষের মনােভঙ্গী আজ কেমন! ভরসা এই, কেহই দেশের সব মানুষকে চিরকাল বােকা বানাইয়া রাখিতে পারে না, ইহারও শেষ পর্যন্ত পারিবেন না। কিন্তু পশ্চিমে যে জাগ্রত জনসাধারণ, এই শাসক-চক্রকে কবরস্থ করিবে তাহার নাম পশ্চিম-পাকিস্তানী জনতা। হয়তাে-বা সিন্ধী, বালুচ বা পাঞ্জাবী জনতা। পশ্চিম-পাকিস্তানেও পাকিস্তানী জাতি বলিয়া কিছু আছে কি নাতাহার শেষ পরীক্ষা বােধহয় এখনও হয় নাই।

২২ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা