নিয়তিরও তরবারি আছে
ব্যাপার দেখিয়া মনে হইতেছে, পশ্চিম পাকিস্তানকে নাদির শাহের ভুতে পাইয়াছে। অতি অদ্ভুত এবং অতিহিংস্র এক আহাদের উৎসৰ জাগাইয়া তুলিয়া নাদির শাহের নাম ও স্মৃতির অভ্যর্থনা করা হইতেছে। এবং নাদির শাহের নাম ও স্মৃতির অভ্যর্থনা করিয়া অতি-হিংস্র এক আহ্লাদের উৎসব জাগাইয়া তােলা হইতেছে। পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁ বলিয়াছেন, তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই চণ্ড নরঘাতকের বংশধর, যিনি ছয় ঘণ্টার মধ্যে দিল্লিতে বিশ হাজার নরনারীকে হত্যা করিবার উৎসব সম্পন্ন করিয়া তাহার রক্তপিপাসু হৃৎপিণ্ডের অভিষেক করিয়াছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খ শুধু তাঁহার বংশ পরিচয়ের নাদিরীয় তথ্যটিকে গর্ব করিয়া প্রচার করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। তিনি নাদির শাহের তরবারিকে হাতে তুলিয়া লইবার এক আনুষ্ঠানিক উৎসবের জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন। এই সংবাদ প্রকাশ করিয়াছেন পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্র “জঙ্গ”। ফারানের নবাবের পূর্বপুরুষ বরাদিন খা নাদির শাহকে লস্কর অনুচর যােগান দিয়া নাদিরের প্রসন্নতা অর্জন করিয়াছিল- এবং পুরস্কার হিসাবে নাদিরের একটি তরবারি পাইয়াছিল। আজিকার ফারানের নবাবের নিকট হইতে সেই তরবারি উপহার পাইয়াছেন বেলুচিস্তানের পাক-জঙ্গী কর্তৃত্বে প্রশাসক লেঃ জেনারেল রিয়াজ হুসেন। এইবার এই নাদিরীয় তরবারিটিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁকে উপহার দিবার ব্যবস্থা করা। হইয়াছে। বুঝিতে অসুবিধা নাই এবং পাকিস্তানের সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের দ্বারাই প্রমাণিত হইতেছে যে, ঐতিহাসিক নরহত্যার এক জল্লাদের নিকট হইতে এক দেশদ্রোহী যে বস্তুটি উপহার পাইয়াছিল আজ তাহাই পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁ-এর হাতে তুলিয়া দেওয়া হইতেছে। স্বীকার করিতে হইবে, ইহা যােগ্যজনের হাতে যােগ্য উপহার প্রদত্ত হইবার এক ভয়ানক-চমৎকার ঘটনা। যাহার প্রমত্ত হিংস্রতা বাংলাদেশের হাজার হাজার নরনারী শিশুকে হত্যা করিয়াছে, গ্রাম পুড়াইয়াছে, ঘরবাড়ি ও কুটির ধূলিসাৎ করিয়াছে, শস্যক্ষেতের উপর রাসায়নিক বিষ ছড়াইয়াছে, তাহারই হাতে নাদিরের তরবারি ভাল মানায় ।
কিন্তু মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই নাদিরীয় তরবারি লইয়া অনুপ্রাণিত হইবার আহাদের মধ্যে বেশি অভিভূত হইয়া আর একটি তরবারির কথা ভুলিয়া গিয়াছে। নাদির জীবনের ইতিবৃত্তের শুরু প্রথম অধ্যায়ের পৃষ্ঠাগুলির দিকে তাকাইয়া তাহারা এতই উল্লসিত হইয়াছে যে, শেষ অধ্যায়ের শেষ পৃষ্ঠাটির দিকে তাকাইয়া দেখা আর সম্ভব হইতেছে না। নাদির শাহ দিল্লির তক্ত-ই-তাউস ও কোহিনুর লুণ্ঠন করিয়াছিল, ইয়াহিয়া খাঁ বাংলাদেশের সােনার দোকান ও ব্যাঙ্ক লুণ্ঠন করিয়াছেন। দিল্লির আক্রান্ত নরনারীর আর্তনাদ নাদিরের কানে বিজয়গর্বের সঙ্গীত হইয়া বাজিয়াছিল। ইয়াহিয়ার কানেও বাংলাদেশের আক্রান্ত নরনারী শিশুর আর্তনাদ নিশ্চয় সফল ইচ্ছার গীতালির মত শুনাইয়াছেন। নাদির ও ইয়াহিয়ার একই নির্মমতার দুই বীভৎস মুখচ্ছবি। সুতরাং যে নিয়মিত নাদিরকে অনুসরণ করিয়াছিল, সেনিয়তি-ইয়াহিয়াকেও অনুসরণ করিবে না কেন?
ইতিহাস বলে সেই নিয়তির হাতেও একটি নিদারুণ তরবারি ছিল। নাদির শাহ এক আততায়ীর তরবারির আঘাতে নিহত হইয়াছিল। ইয়াহিয়াকেও ঠিক ওই ধরনের পরিণাম বরণ করিতে হইবে; এমন ভবিষ্যদ্বাণী করিবার অবশ্য কোন অর্থ হয় না। কিন্তু নিয়তি কোন-না-কোন করাল রূপ লইয়া যে দেখা দিবে, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। আততায়ীর উদ্যত তরবারির দিকে তাকাইয়া সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর নাদির কি বুঝিতে পারে নাই যে, হাজার হাজার নিহত নরনারীর শােণিত বাষ্পের গন্ধ এবং দগ্ধ জনপদের জ্বালা নিয়তির। তরবারি হইয়া দেখা দিয়াছে? ডাক আসিয়াছে, সাড়া দিব না? সময় আর স্রোত কাহারও জন্য অপেক্ষা করে না। নিজ হইতে যে নড়িবে না, এক একটা ঘটনার ঢেউ তাহাকে যাহা অনিবার্য, যাহা অবশ্যম্ভাবী তাহার দিকে ঠেলিয়া লইয়া যায়। ভারত সরকারকে যেমন লইয়া যাইতেছে। ইতিহাসের বিধান এমনই অমােঘ, তাহার চলার পথ এমনই বৃত্তাকার বটে। এইতাে সেদিন যাহারা আলাদা হইয়া গিয়াছিলেন- যাহাদের আলাদা করিয়া দিয়া ঝাড়া হাত পা হইতে চাহিয়াছিলাম। আমরাও কে জানিত, নিয়তির পরিহাসে সিকি শতাব্দী পুরা হইবার আগেই তাঁহাদের নৈতিক দায় আবার আমাদের উপরই আসিয়া পড়িবে। কে জানিত পিণ্ডিতে হঠাৎ-নবাব হইয়া বসিবেন এমন এক খানসাহেব দেশটাকে খান খান করিয়া দিতে আঘাতের পর আঘাত হানিতে যাহার বাধিবে না, আর সেই আঘাতে আর্তমানবতা আমাদেরই দুয়ারে করাঘাত করিবে। এ দেশ চাক বা না-ই চাক পাকিস্তানকে পুরাপুরি গােরস্থানে পরিণত হওয়ার সর্বনাশ হইতে রক্ষা করার কর্তব্য তাহাকে ইদানীং ক্রমাগত ডাক দিতেছে। এদেশের জনমতের চাপ তাে ছিলই, উপরন্তু সীমান্তের ওপারে অলৌকিক এক মুক্তি সংগ্রাম বিদ্যুত্বহ্নিতে ভারতের করণীয় কাজ কী, তাহা চিহ্নিত করিয়া দিতেছে। সেই বিদ্যুৎ-শিখার পাশে জমিয়াছে দলে দলে শরণার্থীর ঘন মেঘ। ফলে ভারত শুধু দর্শক নয়, ভারত দর্শক আদৌ নয়, বরং এই ঘাতপ্রতিঘাতের নাটকে সেও কুশীলব হিসাবে জড়াইয়া পড়িতেছে। গত দুই-তিন দিনের ঘটনাও নাটকীয়।
আমাদেরই সীমান্তের অদূরে নবজাত একটি রাষ্ট্রের প্রথম ক্রন্দন আমরাই শুনিয়াছি। সাড়া দিতে যদি বা দেরী হইয়াছে, ঘটনা অপেক্ষা করে নাই। ইতিমধ্যেই কলিকাতার পাক দূতাবাস বাংলাদেশের নিশান উড়াইয়া, পিণ্ডির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া আমাদের প্রত্যাশিত এবং অপেক্ষিত কর্মটুকু সম্পন্ন করার জন্য প্রবল। একটি চাপ সৃষ্টি করিয়াছে। স্বজাতির উৎসাদনে আহত যে কূটনৈতিক কর্মিবৃন্দ আজ অসমসাহসিক একটা ঝুঁকি লইলেন, আমরা তাহাদের এই কীর্তিকে কীভাবে গ্রহণ করিব? প্রত্যাখ্যান, না অভিনন্দন? উত্তর স্বতঃসিদ্ধ, স্পষ্ট করিয়া বলার প্রয়ােজন নাই। একা কলিকাতা নয়, একে একে আরও অনেক দূতাবাস। কলিকাতার পথ ধরিতে পারে, আরও অনেক কূটনৈতিক কর্মী রাজনৈতিক শরণপ্রার্থী হইতে পারেন। | প্রতিক্রিয়াও অবশ্যম্ভাবী। পিণ্ডি কোনও না কোনও প্রকারে বদল হিতে চাহিতে পারে। যেমন, ঢাকার ভারতীয় মিশনটি বন্ধ করিয়া দেওয়া জানি না সেই সম্ভাবনায় দিল্লি ঘাবড়াইয়া যাইবে কিনা! অথবা সে তখনও শিষ্টাচারের পুঁথিকে তার বেদবং বুকে আগলাইয়া রাখিবে কিনা! আমরা বলি, আর না, ঢের হইয়াছে। পাকিস্তানের জন্মাবধি তাহার আচরণ দুনিয়ার কোন্ সভ্য মুলুকের কে তা মানিয়া চলিয়াছে? দুই দেশের।
সম্পর্ক সত্য সত্যই দুইটি সভ্য দেশের মতাে একদিনের তরেও তাে ছিল না! থাকিলে কাশ্মীর মিথ্যা ১৯৬৫ সনের লড়াই মিথ্যা, এমন কী সেইদিনের হাইজাইকিংও মিথ্যা। পাকিস্তান একটাও রীতিনীতি মানিবে না, আমরা একাই খালি মৈত্রীর তাসখন্দ-মন্ত্র পড়িয়া চলিব? যেটা সত্য, সেটা স্বীকার করিয়া লওয়াই ভাল। স্বীকার করিয়া লওয়ার সময় আসিয়াছে, বাংলাদেশের ঘটনা আমাদের ডাক দিয়াছে। সত্যকে স্বীকারের পথে প্রথম পদক্ষেপ ওই দেশের নবজাত সরকারকে স্বীকৃতি। রবিবার এখানকার পাক দূতাবাসের ঘটনা দিল্লি যে মানিয়া লইয়াছে, সেইটাই তাে এক হিসেবে পরােক্ষ স্বীকৃতি, কিংবা বলা যায়, নীরব অনুমােদন। পরােক্ষকে প্রত্যক্ষ করিয়া লইতে হইবে, নতুবা আইনগত সমস্যার জালে দিল্লি নিজেই জড়াইয়া। পড়িবে। ইসলামাবাদ যদি নূতন এক সেট ডিপ্লোম্যাট কলিকাতায় পাঠাইয়া দেয়? দিল্লি কি তাহাদের দূতাবাস দখল করিতে দিবে? বাংলাদেশে পাক ফৌজ বিনা বাধায় কিন্তু কিছু দখল করিতে পারে নাই। বিনা বাধায় সে মতলব হাসিল করিবে এইখানে? তাহা হয় না। তাহা ওখানকার মানবিক প্রত্যাশাকে অপমান, তাহা এ দেশের জনমতের দাবিকেও দখল । ইয়াহিয়াকে মাওয়ের মাভৈঃ যদি দিল্লির ভয়ের কারণ হইয়া থাকে, তাহাহইলে বলিব, সে ভয় অলীক। এ যুগ প্রধানত গলার জোরে বাজার মাৎ করার যুগ, ব্লাফ আর ব্ল্যাকমেল দিয়া যে যতটা পারে কাজ শুছাইয়া লইতে চায়।
বৃহৎ শক্তিরাও অন্যের মামলায় বড়জোর ওকালতি করে, সক্রিয়ভাবে চট করিয়া কেহ লিপ্ত হয় না। হইতে চায়না। পােল্যান্ডের বিপদে ইংল্যান্ড সবে আগাইয়া আসিয়াছিল, তাহার পর পৃথিবীর বয়স আরও বত্রিশ বৎসর বাড়িয়াছে। একালে শুধুই বেণী না ভিজাইয়া নমাে নমাে স্নান সারার পালা। সাক্ষী হাঙ্গেরী, সাক্ষী চেকোশ্লোভাকিয়া, সাক্ষী পশ্চিম-এশিয়া। এই যে বিলাতী কাগজগুলি বাংলাদেশের ব্যাপারে “চেত রে চেত রে” বলিয়া ডাক ছাড়িতেছে, ব্রিটেন আদৌ চেতিয়া উঠিয়াছে কি? মার্কিন মুলুকও, কিটিং কিংবা বােলজ যাহাই বলুন, চট করিয়া নির্দিষ্ট কোনও নীতি লইবে বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু ভারতের কথা আলাদা। সে প্রতিবেশী, যে চালে আগুন লাগিয়াছে, তাহার পাশের চালটি তাহার, বস্তুত দুইটি চাল এই সেদিনও একই বসত বাড়ির দুইটি ভিটা ছিল। ঘটনাটা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার, এই দাবিটা ধােপে টেকে না। এটা ঘরােয়া ব্যাপার হইলে দক্ষিণ-আফ্রিকাও ছিল স্মাটস-ভেরউড সাহেবদের ঘরােয়া ব্যাপার, রােডেশিয়া ছিল ইয়ান স্মীথ এর। সেখানে তবে আমরা সােৎসাহে উৎসুক্য দেখাইতে গিয়াছিলাম কেন? কেন কঙ্গোতে ফেীজ পাঠাইয়াছিলাম? নীতিবােধের আহ্বানেই তাে? সেই আহ্বান আজ। ঘরের কাছে একেবারে কানের পাশে মন্ত্রিত হইয়া উঠিয়াছে। সাড়া দিব না?
২০ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা