বর্বরের ব্যবহার
শিলাইদহের কুঠিবাড়ির খবর আগেই মিলিয়াছিল। এখন জানা গেল, পাক সেনারা সাংস্কৃতিক-স্মৃতি-বিজড়িত আরও একটি বাড়িকে বিনষ্ট করিয়াছে। কুমিল্লা শহরে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর অনুজ স্বৰ্গত ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সেখানে বাস করিতেন, বাড়ি না বলিয়া তাহাকে পবিত্র স্মৃতিতীর্থ বলাই ভাল। প্রাচীন সংগীতের নথিসহ বহু দুষ্প্রাপ্য পুস্তক ও পুঁথি সেখানে সযত্নে রক্ষিত ছিল। কিন্তু অমূল্য সেই ঐশ্বর্য আর এখন নাই । যেমন সেই সুরস্রষ্টার গৃহটিকে, তেমনি তাহার পুস্তক ও পুঁথির বিশাল সংগ্রহকেও পাক সেনারা সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। সংবাদটা বেদনাদায়ক, কিন্তু বিস্ময়কর নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাক করিয়া যাহারা কামান দাগিয়াছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর যাহারা বােমা ফেলিয়াছে, এবং পণ্ডিত, অধ্যাপক কবি ও বুদ্ধিজীবীদের পাইকারীভাবে হত্যা করিতে যাহাদের হাত কাঁপে নাই, অন্য আর কোন্ আচরণ তাহাদের কাছে আশা করা যায়? বর্বরের পক্ষে যাহা স্বাভাবিক, তাহাই তাহারা করিয়াছে। তাহা না-করিলেই বরং বিস্ময়ের কারণ ঘটিত। নির্বুঢ় বর্বরতার দৃষ্টান্ত যে এই প্রথম দেখা যাইতেছে, তাহাও নয়। ইতিহাসের যে-কোনও ছাত্র বলিয়া দিবেন; পৃথিবীর নানা দেশে নানা নামে ইহার আগেও অসংখ্যবার এই বর্বরদের দেখা গিয়াছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শনগুলিকে নির্বিচারে ধ্বংস করিতে তাহাদের বিবেকে বাধে না। বস্তুত বিচারবুদ্ধি আর বিবেকের বালাই নাই বলিয়াই হয়ত ধ্বংসে তাহাদের এত আনন্দ, সংহারে তাহাদের এত উল্লাস। আজ যাহারা শিলাইদহের কুঠিবাড়ি ও কুমিল্লার ওই সংগ্রহশালা ধ্বংস করিয়াছে, ভিন্ন নামে ও ভিন্ন পরিচয়ে তাহারাই বার বার আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্ববিখ্যাত প্রন্থাগারকে ধ্বংস করিয়াছিল। আজ যাহারা ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে গােলা আর বােমার লক্ষ্য করিয়াছে, ভিন্ন নামে আর ভিন্ন পরিচয়ে তাহারাই একদা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভস্মীভূত করিয়াছিল ।
তাহারাই একদা এলিফ্যান্টার ত্রিমুর্তিকে তাক করিয়া বন্দুক হুঁড়িয়াছে; তাহারাই একদা- ইউরােপের জ্ঞানী-সমাজকে ঘরছাড়া করিয়াছিল। ভিন্ন নামে তাহারাই সর্বযুগে বই পােড়ায়; মুর্তি ভাঙে, জ্ঞানীর হাতে বিষের ভাণ্ড আগাইয়া দেয়। পুঁথি আর পুস্তকের শত্রু কি শুধু উই আর ইদুর! চিত্র আর ভাস্কর্যের শত্রু কি শুধু তঙ্কর আর লােনাহাওয়া তা নিশ্চয় নয়। শত্রু আরও অনেক। সবচাইতে বড় শত্রু সেই অসভ্য বর্বরের দল, নিজেরা অসভ্য বলিয়াই সাহারা- শিল্প-সংস্কৃতি, সভ্যতার নিদর্শনগুলিকে সহ্য করিতে পারে না। সভ্য মানুষ তিলে তিলে যাহাকে গড়িয়া তােলে এবং গড়িয়া তােলাকেই মনুষ্যত্ব বলিয়া মনে করে, অসভ্যের আক্রমণে নিমেষে তাহা ধূলায় লুটায়। ম্যাসিডনের সেনারা যখন থীবস লুণ্ঠন করিয়াছিল, কবি পিন্ডারের বাড়িটিতে তাহারা তখন হাত দেয়। নাই । দিবার উপায় ছিলনা। আলেকজান্ডার বলিয়া দিয়াছিলেন, পূণ্যস্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িটিতে হাত দেওয়া। চলিবে না। কিন্তু পাক ফৌজ যে নেতৃত্বের নির্দেশে চালিত, সেই নেতৃত্বও সমান বর্বর; কবি শিল্পী, পণ্ডিতসুরস্রষ্টার কোনও পৃথক মূল্য তাহাদের কাছে নাই। তাহাদের আচরণ দেখিয়া মনে হয় যে, ইতিহাস-ধিকৃত। সেই বর্বরেরা আবার নরক হইতে ফিরিয়াছে, এবং নূতন নামে জন্ম লইয়া, শিক্ষা সংস্কৃতি ও সুরুচির দিকে কামান তাক করিয়া হাসিতেছে।
১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা