নব অভ্যুদয়
স্বাধীন বাংলাদেশের অত্যুদয় হইয়াছে ২৬ মার্চ। জন্মের পর হইতেই শুধু বাঁচিয়া থাকার জন্যই তাহাকে এমন প্রচণ্ড সংগ্রাম করিতে হইতেছে যে, সে স্বাধীনতাকে সুসংবদ্ধ ও সংহত করিবার জন্য যে প্রশাসনিক কাঠামাে গড়িয়া তােলার দরকার সে দিকে দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশ তাহার কর্ণধারদের হয় নাই। শত্রু যে রণে ভঙ্গ দিয়াছে এমন নয়। তবুও নবজাতককে তাহার প্রাপ্য মর্যাদায় মণ্ডিত করিতে গেলে যে আয়ােজন করা প্রয়ােজন তাহাতে হাত দিয়াছে স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ। নূতন রাষ্ট্রের সরকার গঠনের প্রাথমিক পর্ব সম্পন্ন হইয়াছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নবগঠিত সরকারের প্রেসিডেন্ট, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ তাহার প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া আছেন উপরাষ্ট্রপতি এবং তিনজন মন্ত্রী। তাহারা সকলেই যে আওয়ামী লীগের দিপাল, সে কথা কাহাকে বলিয়া দিতে হইবে না। নুতন রাষ্ট্রের এটি আপকালীন সরকার। স্বভাবতই তাহার আয়তন ক্ষুদ্র। অতি-পুরাতন দেশেও যুদ্ধের সময় যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় সেটির আকার-কখনও বৃহৎ হয় না, সদ্যভূমিষ্ঠ না হইয়াই পারে না। এ মন্ত্রীসভার প্রধান কাজ হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করিয়া দেশ হইতে বিতাড়িত করা। তাহার জন্য যা কিছু করা দরকার সে সবই করিবে বাংলাদেশের সংগ্রামী নায়কেরা প্রস্তুত, তাহার প্রমাণ ভূরি ভূরি মিলিতেছে। দেশের লােকেরও তাহাদের উপর যে অগাধ বিশ্বাস, সে তত্ত্ব বিশ্ববাসীর আজ অজানা নাই । তাহারা জনগণের এমন শ্রদ্ধাভাজন বলিয়াই এত সামরিক সরঞ্জাম ও শিক্ষিত ফৌজ সত্ত্বেও মুক্তিসেনানীর সঙ্গে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী আটিয়া উঠিতে পারিতেছেনা- নিরস্ত্র জনগণের উপর বর্বর অত্যাচার করিয়াও তাহাদের মনােবল হানাদার ফৌজ ভাঙিতে পারিতেছে না। আধুনিক কোনও মারণাস্ত্রেরই তাহাদের অভাব নাই। তবুও এ অসম দ্বন্দ্বে জয়লাভের সৌভাগ্য হইতে তাহারা আজও বঞ্চিত।
মুক্তি সেনারা এ যাবৎ যাহা করিয়াছে তাহা কাহিনীর মতই শােনাইতেছে। ভবিষ্যতে তাহাদের নির্ভীক প্রতিরােধের বৃত্তান্ত নিঃসন্দেহে উপকথায় পরিণত হইবে। জয় তাহাদের সুনিশ্চিত। তবুও সে বিজয়কে যদি ত্বরান্বিত করিতে পারা যায় তাহা হইলে অনেক যন্ত্রনার হাত হইতে বাংলাদেশের অধিবাসীরা নিস্তার পাইবে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি তাঁহাদের বাঁচিয়া যাইবে। একটা বিধিমতে গঠিত সরকার যখন শাসনতরীর হাল ধরিয়াছেন তখন গণতন্ত্রী দুনিয়ার উচিত তাহাদের বুনিয়াদ যাহাতে শক্ত হয় তাহার ব্যবস্থা করা। তাহারই মুখবন্ধ হইবে নূতন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া, বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তাকে মানিয়া লওয়া। সে দেশের অধিকাংশ নাগরিকের সমর্থন যাহার দিকে সেই তাে প্রকৃত সরকার। তাহাতে তাহার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে গণতন্ত্রী দেশগুলির অন্তত কুণ্ঠিত হইবার কোন সঙ্গত কারণ নাই। তাহাদের দ্বিধার হেতু অবশ্য পাকিস্তানের আপত্তি । কিন্তু তাহাতে কী? ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু অঙ্গচ্ছেদ তাে ইসলামাবাদ নিজেই করিয়াছে, জনগণের ইচ্ছাকে দুই পায়ে দলিত করিয়া। বাংলাদেশে যাহারা দিপাল তাহারা প্রভুত্ব লাভ করিয়াছেন পশুবলে নয়, লােককে বাহুবলে আতঙ্কগ্রস্ত করিয়া নয়, জনগণের চিত্তজয় করিয়া । সে জয়ও হইয়াছে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে। নির্বাচনে এমন সাফল্য ইতিপূর্বে কোথাও কখনও কোনও দেশে কোনও দলের হইয়াছে কিনা সন্দেহ। সে নির্বাচনকে ইয়াহিয়া খা ভাওতা বলিয়া উড়াইয়া দিতে পারেন না। কেননা তাহার আয়ােজন তিনিই করিয়াছিলেন। তাঁহার নির্দেশেই সে নির্বাচন পরিচালিত হইয়াছিল। সেই সম্পূর্ণ বৈধ নির্বাচনের রায়কে অগ্রাহ্য করার অর্থ গণতন্ত্রকে গলা টিপিয়া মারা। অতঃপর স্বাধীনতা ঘােষণা ছাড়া বিজয়ী আওয়ামী লীগের কী উপায় ছিল? আর সেই স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার অধিকার কোনও গণতান্ত্রিক দেশের অন্তত নাই। বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মৌখিক নিন্দা অনেক দেশেই হইয়াছে। তাহাতে নিষ্ঠুর রক্তপাত সেখানে বন্ধ হয় নাই। সে রক্তপাত বন্ধ হইবে যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নূতন রাষ্ট্রের বাহুতে নববলের সঞ্চার করে।
১৪ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা