নূতন এই উদবাস্তু- প্রবাহ
পিণ্ডির খাঁ সাহেবরা দাবি করিতেছেন পূর্ব-বাংলার অবস্থা স্বাভাবিক। সেটা যে ধোকা মাত্র, সে বিষয়ে দুনিয়ার কাহারও মনে সংশয় নাই । সম্ভবত ইয়াহিয়া খাঁর দোস্তদের মনেও। বাংলাদেশের আগুনের শিখা কাহার চোখ এড়াইবার কথা নয়। অবশ্য অন্ধদের কথা স্বতন্ত্র। পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদারদের ধ্বংসলীলার চিহ্ন সর্বত্র। সীমান্তের এপারও জলজ্যান্ত প্রমাণ; বাংলাদেশে যদি জীবন যাত্রা স্বাভাবিকই থাকিত তবে কেন এই উদ্বাস্তুস্রোত? ঘরবাড়ি ছাড়িয়া এইসব অসহায় মানুষ নিশ্চয়ই হাওয়া খাইবার জন্য এপার বাংলায় পাড়ি। জমাইতেছেন না। পশ্চিম-বাংলা সরকার জানাইয়াছেন ইতিমধ্যেই প্রায় ছয় হাজার মানুষ এই রাজ্যে আশ্রয়। লইয়াছেন। পূর্ব-বাংলা এবং ভারতের দীর্ঘ সীমান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এই হিসাবকে চূড়ান্ত বলা যাইতে পারে না।পশ্চিম-বাংলা ছাড়াও বিস্তর শরণার্থী আশ্রয় লইয়াছেন ত্রিপুরা এবং আসামে। ত্রিপুরার ট্রানজিট ক্যাম্প রীতিমতাে বোেঝাই। অথচ সবে কলির সন্ধ্যা, মুক্তিযুদ্ধ তৃতীয় সপ্তাহে পড়িল মাত্র; এবং পর্যবেক্ষকদের ধারণা এই ঐতিহাসিক লড়াই দীর্ঘ হওয়ারই সম্ভাবনা।। এবারকার উদ্বাস্তু-প্রবাহ অবশ্য একটু অন্য ধরনের। আগন্তুকদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই আছেন। ইয়াহিয়ার লড়াই এবার বাঙালীর বিরুদ্ধে। হিন্দু তাঁহার ফৌজের বিশেষ লক্ষ হইলেও মুসলমানকেও বাদ দেওয়া হইতেছেনা। সুতরাং হিন্দু মুসলিম একযােগে যেমন জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছেন তেমনই এক সঙ্গে সীমান্ত পার হইতেছেন। তৎসহ কিছু কিছু অবাঙালী আশ্রয় প্রার্থীও জুটিতেছেন। সব মিলাইয়া এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। ইহার পরওকি বলা চলে বাংলাদেশে যাহা হইতেছে তা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার? শুধু এই উদ্বাস্তু উপলক্ষ্যেই ভারত পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক জনমতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাইবার অধিকারী। এই পরিস্থিতি, ক্রমে আরও জটিল রূপ লইতে বাধ্য।
কেন না, লড়াইয়ের জের হিসাবে বাংলাদেশে ক্রমে অন্য সমস্যাও দেখা দিবে। কিছু মানুষ যেমন পশ্চিমী ফৌজের হাত হইতে প্রাণ-মান বাচাইবার জন্য এ দেশে আসিতেছেন তেমনই অনেকে আসিবেন ক্ষুধার তাড়নায়। ‘অক্সফার্ম” প্রভৃতি বিদেশী ত্রাণসংস্থা বলিতেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে অন্তত পনেরাে লক্ষ মানুষ অনাহারের কবলে। সুতরাং সীমান্তের এপারে ভিড় আরও বাড়িল বলিয়া। ভারত বাংলাদেশের মানুষের এই মুক্তিযুদ্ধে নৈতিক সমর্থন জানাইয়াছে। সেই নৈতিকতাই মানবিকতার। দাবি মানিয়া লইয়া সীমান্তের দুয়ার খুলিয়া দিয়াছে। সেটা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। কিন্তু সে দায়িত্ব শুধু রাজ্য সরকার গুলির ঘাড় চাপাইয়া দিলে চলিবে কেন? পশ্চিম বাংলা সরকার সীমান্তে তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র গুলিয়াছেন। ত্রিপুরা এবং আসামও আগাইয়া আসিয়াছে। সকলেরই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। পশ্চিম-বাংলার তরফ হইতে কেন্দ্রের কাছে অতিরিক্ত চাল ইত্যাদি দাবি করা হইয়াছে। আশা করা যায়, এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সাড়া মিলিবে। বিশেষত, এবারকার উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে পুনর্বাসনের ভাবনা কম; অনেকেরই মনােগত বাসনা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। অর্থাৎ সাময়িক ব্যবস্থাদির বেশি কিছু এই মুহূর্তে প্রয়ােজন নাই। কথা এই, সেটুকুই বা একা ভারত করিবে কেন? আমাদের মনে হয়, এ ব্যাপারে সহানুভূতিশীল দেশগুলিকেও আহ্বান করা প্রয়ােজন। ইহা কোনও রাজনৈতিক প্রস্তাব নয়, স্রেফ মানবিকতার ডাকে সাড়া দেওয়ার আহ্বান। ইহার জন্য নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খার অনুমতি প্রয়ােজন হইবে না। আন্তর্জাতিক রেডক্রস ঢাকায় যাইতে পারেন নাই বলিয়াই হাত-পা ছাড়িয়া বসিয়া থাকা কেন, তাহাৱা নিশ্চয় বেনাপােল, গেলে এসব জায়গায় আর্তের পাশে আসিয়া দাড়াইতে পারেন।
১১ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা