বামও বাম, দক্ষিণও
বাংলাদেশে নগরে নগরে গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ তীব্র হইতে তীব্রতর হইতেছে। লক্ষ লক্ষ চিরিয়া ঝাকে ঝাকে প্রাণ পক্ষীসমান যেন নিজ নীড়ে ছুটিতেছে। ওদিকে পিন্ডি-প্রাসাদকুটে বারবার পশ্চিম-পাকিস্তানের বাদশা ইয়াহিয়া খার দ্ৰিা টুটিয়া যাইতেছে, সঙ্গে সঙ্গে দিগ্বিজয়ের নেশা কাটিয়া যাইবারও উপক্রম। বেয়াড়া বাঙালীদের বেয়াদবি এবং পয়লা নম্বর দুশমন ভারতবর্ষের কান-ভাঙানি যে এমন করিয়া তাহাকে পথে বসাইবে, এ কথা কে আগে ভাবিতে পারিয়াছিল? নূতন দোস্ত রাশিয়া এক পত্রাঘাত করিয়া বুকে যে দাগা দিয়াছে তাহার ব্যথা মরিতে না-মরিতে চিরদিনের মুরুব্বী আমেরিকাও কিনা শেল হানিয়া বসিল। এই সাঁড়াশি আক্রমণের কষ্ট, কি মুজিবসেনার পালটা মারের বেদনার চেয়ে কিছু কম? ভারতবর্ষের বিষাক্ত কূটনৈতিক বানের জ্বালা তাে এ অপ্রত্যাশিত আঘাতের ব্যথার কাছে কিছুই নয় । রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পদোগণির বার্তা ইয়াহিয়া খাকে ভাবাইয়া তুলিলেও পশ্চিমপাকিস্তানের জঙ্গী প্রধান প্রমাদ গণেনও নাই। মস্কো তাে তাহার হাতের পাঁচ। সেটা যদি যায়ও তবুও তিনি একেবারে মাত হইবেন মস্কো তাহার ভরসা নয়, ভরসা ওয়াশিংটন। সােভিয়েত দেশকে নিজের দিকে টানিয়া আনিতে চাহিয়াছিল পাকিস্তান ভারতবর্ষকে নির্বান্ধব করিবার উদ্দেশ্যে। মস্কোও যদি দিল্লিকে বর্জন করে, তাহা হইলে বন্ধু রাজধানী বলিতে ভারতবর্ষের থাকিবে কে? রাশিয়াকে পাকিস্তান ভজনা করিয়াছে বামপন্থী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হইয়া নয়, ভারতবর্ষের সঙ্গে কৌশলে তাহার বিচ্ছেদ ঘটাইতে। সে চক্রান্ত অবশ্য সফল হয় নাই, কিন্তু মস্কোর মন কিছুটা অন্তত ইসলামাবাদ ভিজাইতে পারিয়াছে। তাহার কারণ পিকিংয়ের সঙ্গে মস্কোর মতান্তর।
চীনের গ্রাস হইতে সম্ভব হইলে পাকিস্তানকে উদ্ধার করিয়া আনিবার উদ্দেশ্যেই রাশিয়া পাকিস্তানের পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। ইসলামাবাদের লাভ তাহাতে মন্দ হয় নাই, বিস্তর সামরিক সামগ্রী সে ঘরে তুলিতে পারিয়াছে। কাশ্মীরে ভারতবর্ষের পাকা খুঁটি কঁাচাইতে সে আজও পারে নাই, কিন্তু কিছুটা ঝামেলার সৃষ্টি তাে সে রাজ্যে সে করিতে পারিয়াছে। চোরের তাে রাত্রিবাসই লাভ। তাহার আশা ছিল অন্তত চীনের কথা ভাবিয়া সহজে পাকিস্তানকে রাশিয়া ঘাটাইবে না। কিন্তু পদোগৰ্ণির চিঠি প্রমাণ করিতেছে, সে হিসাবে গলতি রহিয়া গিয়াছে। পাকিস্তানের বাড়াবাড়ি বরদাস্ত করিতে রাশিয়া প্রস্তুত নয়। এতদিন তবু যাহােক ইয়াহিয়া খার একটা সান্ত্বনা ছিল যে ক্যুনিস্টদের চালচলনই আলাদা। কিন্তু তাহার মাথায় বাজ ভাঙিয়া পড়িয়াছে খােদ আমেরিকার ভাবগতিক দেখিয়া । বাংলাদেশে অকারণ রক্তপাত বন্ধ করিবার অনুরােধ ওয়াশিংটনের পক্ষ হইতে জানানাে তাে হইয়াছেই, আবার সে যুদ্ধে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের বিরূপ সমালােচনাও করা হইয়াছে। এমন আভাসও দেওয়া হইয়াছে যে তেমন বুঝিলে আমেরিকা সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানকে আর যােগাইবে না। এ হুমকিতে ইয়াহিয়া খান ততটা উদ্বিগ্ন নন, যতটা এই আশঙ্কায়, শেষ পর্যন্ত আমেরিকা না বাংলাদেশকে দুম করিয়া স্বীকৃতি দিয়া বসে। এ অবস্থায় চীনের মিষ্ট কথাতেও ইয়াহিয়া খা বিশেষ স্বস্তি পাইতেছেন না। পিকিং-এ তিনি নাকি বিশেষ দূত পাঠাইয়াছেন। কিন্তু কেন? নিছক ধন্যবাদ দিতে নিশ্চয়ই নয়। এক তাে চীনের বক্তব্য যেটুকু প্রকাশিত হইয়াছে তাহাতে পশ্চিম-পাকিস্তানের সান্ত্বনার কী আছে? তাহার উপর তাহার আসল ব্যথার জায়গায় তাে চীন প্রলেপ দেয় নাই। | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উপলক্ষ্য করিয়া পিকিং নয়াদিল্লিকে এক হাত লইয়াছে, কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানের কাছে যে আসল আসামী সেই শেখ মুজিবর রহমান ও তাহার আওয়ামী লীগের কোন নিন্দা তাে চীন করে নাই, তাহাদের আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেওয়া তাে দূরের কথা। ভারতবর্যের উপর ইয়াহিয়া খাঁর প্রচণ্ড রাগ, এ দেশের সম্বন্ধে কেহ কু গাহিলে তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া ওঠেন। এখন কিন্তু তিনি আরও কিছু চান। তাহার দোস্তদের নিকট হইতে। সেটা হইতেছে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের মুণ্ডপাত । তাহাতে তাে দেখি কাহারও আগ্রহ নাই, এমন কী প্রজাতন্ত্রী চীনেরও নয়।
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা